Tiger

International Tiger Day: বিশ্ব বাঘ দিবস এখন শুভেচ্ছা-সর্বস্ব দিন, ওদেরও যে দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে জানি কি?

আবার অন্য দিকে কথা উঠছে, এই বাঘ-বাঘ করে আদিখ্যেতায় চাপা পড়ে যাচ্ছে কম নায়কোচিত বন্যপ্রাণ প্রজাতিদের দুর্দশার কথা।

Advertisement

জয়দীপ সুচন্দ্রা কুন্ডু

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২২ ১১:৩৮
Share:

ছবি: জয়দীপ সুচন্দ্রা কুন্ডু।

বাঘ নিয়ে লিখতে বসেছি বাঘ দিবসে। যদিও বাঘ নিয়ে নতুন কোনও তথ্য আমি দিতে পারব না। সংবাদপত্র ও পত্রিকায় ছাপা প্রবন্ধ, পাঠ্যবই, গল্পের বই, শিকারের বই, ইতিহাসের বই, লোকগাথার বই, বিজ্ঞানের বই, গবেষণাপত্র, সংরক্ষণবাদীদের লেখা এবং বক্তব্যের বই, তথ্যচিত্র, ফিচার ফিল্ম, বিজ্ঞাপন এবং বর্তমানে ডিজিটাল মিডিয়ায় প্রকাশ পাওয়া লেখা, ছবি, ভিডিয়ো, খবর ইত্যাদির সহস্রাধিক তথ্য আমাদের বাঘ সম্পর্কে যা জানানোর, সব জানিয়ে দিয়েছে। ছোট্ট শিশু, সে যে কালেরই হোক না কেন, বাঘ চেনে। একটু-আধটু বাঘ নিয়ে কাজ করার সূত্রে বিয়েবাড়ি থেকে পুরীর মন্দির— যেখানেই যাই, কেউ না কেউ প্রশ্ন করে, ক’টা বাঘ আছে দেশে?

Advertisement

এখন আবার বিগত তিন-চার বছর ধরে শুনতে হচ্ছে, বাঘের সংখ্যা তো বেশ বেড়েছে দেখছি! সুতরাং, সকলে জানে বাঘ নিয়ে কী হচ্ছে। বাঘের অবস্থা কেমন। বাঘ কী খেতে ভালবাসে। বাঘ খুব ভাল ক্যামেরার সামনে পোজ দেয়। কোন জঙ্গলের বাঘের কী ডাকনাম। কোন বাঘ কার মেসো বা কার কাকা। কাকে বন দফতরের ‘কাজ না জানা কর্মীরা’ ঠিক সময়ে গ্রাম থেকে বনে পৌঁছে দিতে পারেননি। কোন বাঘ মানুষখেকো। কোন বাঘ আগে মানুষ খেত কিন্তু এখন আর খায় না। বাঘ নিয়ে সব তথ্য লোকজনের কণ্ঠস্থ। মুখস্থ। তাই কয়েক বছর ধরে ২৯ জুলাই ভোর রাত থেকেই মোবাইলে মেসেজ আসা শুরু হয়ে যাচ্ছে— ‘শুভ বাঘ দিবস’। ব্যাপারটা এখন ঠিক ফাদার্স ডে, মাদার্স ডে, ভ্যালেন্টাইন্‌স ডে বা ওই ‘শুভ মহালয়া’র মতো শুভেচ্ছা-সর্বস্ব দিন হয়ে গিয়েছে। সবাই খুব সচেতন। বাঘ নিয়ে চিন্তা করার আর কোনও অবকাশই নেই।

আবার অন্য দিকে কথা উঠছে, এই বাঘ-বাঘ করে আদিখ্যেতায় চাপা পড়ে যাচ্ছে কম নায়কোচিত বন্যপ্রাণ প্রজাতিদের দুর্দশার কথা। বাঘের জন্য প্রচুর অর্থব্যয়, কিন্তু বাঘ ছাড়া অন্য জীববৈচিত্রের জন্য কাজ করার টাকা দিতে কেউ রাজি নয়। বাঘ ‘ক্যারিশম্যাটিক’, তাই তার জন্য এত চিৎকার! নীরবে অন্য লুপ্তপ্রায় প্রাণীরা এক এক করে বিলুপ্তির খাদের ধারে এসে দাঁড়াচ্ছে।

Advertisement

বাঘ ‘ক্যারিশম্যাটিক’, তাই তার জন্য এত চিৎকার!

গভীর সমস্যা। বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ এখন দু’ভাগে বিভক্ত। এক দল বলছে, বাঘের সংরক্ষণ আর দরকার নেই। যথেষ্ট হয়েছে। আর এক দল বলছে— বাঘ বাঁচাও।

সুন্দরবন থেকে প্রায়ই খবর আসে, কাঁকড়া শিকার করতে গিয়ে মানুষকে বাঘে টেনে নিয়ে গিয়েছে। অতিমারির পর খবরটা বেশ বেশি আসছে। শুধু তা-ই নয়, বেশ কয়েক বছর গত শীতের মরসুমে বাঘেদের গ্রামে ঢোকার হিড়িক পড়ল। নেটমাধ্যমের ‘এক্সপার্ট’দের মতামতের বহর ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচের কথা মনে পড়িয়ে দিল।

অন্য দিকে, বিশেষজ্ঞদের খুবই প্রাথমিক একটি স্টাডি জানাচ্ছে, সুন্দরবনের জঙ্গলের ‘ক্যারিং ক্যাপাসিটি’র তুলনায় বাঘ হয়তো বা বেশি। এই ‘ক্যারিং ক্যাপাসিটি’ হল জঙ্গলের বাঘধারণ ক্ষমতা। ২০১৫ সালে দুই দেশ মিলিয়ে ২,৯১৩ বর্গ কিলোমিটার ছড়িয়ে থাকা আটটি ব্লক ধরে চালানো ভারত-বাংলাদেশের যৌথ একটি সমীক্ষা জানায়, ১০০ বর্গ কিলোমিটারে ২.৮৫ টি (ধরুন তিনটি) বাঘ ভাল ভাবে থাকতে পারে। তখন এ-ও বলা হয়েছিল, বাদাবনের কঠিন পরিবেশই সুন্দরবনের বাঘের ঘনত্ব কম হওয়ার কারণ। অথচ ২০১৮-র ‘টাইগার এস্টিমেশন রিপোর্ট’-এ পাওয়া বাঘের সংখ্যা (৮৬-৯০) অনুযায়ী এখন ‘ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া’র চলমান সমীক্ষা জানাচ্ছে, বাদাবনের জঙ্গলে নাকি বাঘের ঘনত্ব তথাকথিত ধারণক্ষমতার খুব কাছে।

সংখ্যাতত্ত্ব তার নিজের কথা বলে। যেটা চোখ এড়িয়ে গেল, সেটা হল, লকডাউনের কারণে সুন্দরবনের বাইরে রোজগার হারানো এক বিশাল সংখ্যার মানুষের বাড়ি ফিরে আসা। চোখ এড়িয়ে গেল বাঘের জঙ্গলের ধারের অসংখ্য গ্রামের জমির আমপান ও ইয়াসের মতো দু’টি সাইক্লোন ঠেলে উর্বরতা হারানো। চোখ এড়িয়ে গেল শহরের রেস্তরাঁর মেনুতে কাঁকড়ার সুস্বাদু পদ বৃদ্ধি পাওয়া।

ধরুন, একটি ঘরে ১০ জন মানুষ ভাল ভাবে থাকতে পারে। হঠাৎ সেখানে আসবাবপত্র ঢুকিয়ে দিলাম। ১০ জন মানুষের আরাম শেষ। এ বার তাঁদের মধ্যে চাপাচাপি শুরু হল। এক জন একটু আরাম পেতে এক বার দরজার বাইরে বেরোতেই তাঁকে বাইরে থেকে হুমকি, আঘাত ইত্যাদি করা হল। নিরুপায় হয়ে তিনি আবার ঘরে ঢুকলেন। আরও আসবাব। আবার আরও এক-দু’জনের বাইরে আসার চেষ্টা। আবার আক্রমণ। এ বার বাইরের সঙ্গে বেরিয়ে আসা দু’এক জনের বাঁচার লড়াই। এটাই সুন্দরবনের বাঘের গল্প।

শুধু সুন্দরবন নয়, সারা দেশের বাঘের গল্প। শুধু বাঘ নয়, সমস্ত বড়-ছোট বন্যপ্রাণের গল্প। এই গল্প নেটমাধ্যমে প্রতি মুহূর্তে ‘আপলোড’ হওয়া সুন্দর সুন্দর ‘ফিল গুড’ ছবির গল্প নয়। এই গল্প, পিঠ ঠেকে যাওয়া বাঘ ও সমগ্র বন্যপ্রাণের তিলে তিলে মরে বেঁচে থাকার।

সুন্দরবনের ক্ষেত্রে ওই আসবাবপত্র হল বাদাবনের জঙ্গলে মানুষের অতিরিক্ত বিচরণ। যেখানে উপমহাদেশের অন্যান্য বাঘের জঙ্গলে মানুষের প্রবেশ ছাড়াও আছে উন্নয়নের নামে জঙ্গলনিধন। হাইওয়ে, মাইনিং, রেললাইন, বেআইনি বসতি আরও কত কী! আর সব ক্ষেত্রেই দরজার বাইরের আতঙ্ক হল, জঙ্গলের ধারে থাকা গ্রাম বা আধা শহরের মানুষ।

লকডাউনে উপার্জনহীন মানুষ জঙ্গলনির্ভর হয়েছে বিপুল ভাবে। তাদেরও পিঠ ঠেকা। তারাও নিরুপায়। জঙ্গলের মাছ, কাঁকড়া ধরে পেট চালাবে। কিন্তু বনের ভেতর অসংখ্য লোকের বিচরণে টালমাটাল বাঘেদের জীবনের স্বাভাবিক চক্র। স্বাভাবিক ভাবেই সুন্দরবনে বাঘকে শীতকালে একটু বেশি সক্রিয় হতে দেখা যায়। তারা বার বার চেষ্টা করে এই উপদ্রবের হাত থেকে বেরোতে। তাদের আটকায় বন দফতরের দেওয়া ‘নাইলন নেট ফেন্সিং’। কিন্তু বার বার সচেতন করা সত্ত্বেও সেই ‘ফেন্সিং’ও কেটে জঙ্গলে ঢোকে কিছু অবাধ্য লোক আর সেই কাটা অংশ দিয়ে বাঘ বার-বার ঢুকে পড়ে গ্রামের ধারের ম্যানগ্রোভে।

এটাই প্রতিটি গ্রামের ঘটনা, যেখানে বাঘ ঢুকেছিল গত বছর। যা নিয়ে এত সমীক্ষা, এত বিশ্লেষণ। সব থেকে বড় কথা হল, গ্রামে বাঘ ঢোকার ঘটনা নতুন কিছুই নয়। সুন্দরবনের গ্রামে বাঘ এর আগে বহু বার ঢুকেছে। সচেতন গ্রামবাসী সব সময়েই বন দফতরের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে তাকে ধরতে বা জঙ্গলে ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন।

এ বার আসি জঙ্গলে বাঘের আক্রমণ নিয়ে।

তবে তারও আগে একটা কথা বলি। সুন্দরবনের বাঘ মানুষখেকো নয়। কোনও দিনই নয়। কখনওই নয়। সুন্দরবনের বাঘ যদি ‘জেনেটিক্যালি’ মানুষখেকো হত, তা হলে বনের ধারে ১০ মিটারের ব্যবধানে থাকা গ্রামগুলিতে তো রোজ এক জন করে শিকার হত! এই ‘মিথ’টাকে বাঁচিয়ে রেখেছে কিছু অসাধু লোকজন, নিজেদের স্বার্থে। এবং সব থেকে বড় কথা হল বাঘ সে যে জঙ্গলেরই হোক না কেন, মানুষকে এড়িয়ে চলে। সে পছন্দ করে না মানুষকে। দূরে থাকতে চায় মানুষের থেকে।

সুন্দরবনের ক্ষেত্রে বাঘ তার বাদাবনের জঙ্গলের ভিতর মানুষকে দেখে তার শিকার হিসেবে। সুন্দরবনের গ্রামে বাঘ ঢুকলে গরু-ছাগল ছাড়া মানুষ মারার রেকর্ড নেই। ২০০৫-এর রুপালি বাউলির ঘটনা সম্পূর্ণ ভাবে একটি আকস্মিক দুর্ঘটনা।

প্রতিটি গ্রামের ঘটনা, যেখানে বাঘ ঢুকেছিল গত বছর। যা নিয়ে এত সমীক্ষা, এত বিশ্লেষণ।

সুন্দরবনে যাঁরা চিরাচরিত প্রথায় মাছ ধরেন, তাঁদের মধ্যে বাঘের হাতে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা তুলনামূলক কম। যাঁরা দুর্ঘটনায় পড়ছেন, তাঁদের অধিকাংশই কাঁকড়া ধরতে যান। কাঁকড়া হল নদীর দামি ফসল। শহরের বাজারে কাঁকড়া বহুমূল্য। লোভ কিছু মানুষকে ঠেলে দেয় ঝুঁকি নিয়ে জঙ্গলের পাড়ে নেমে গভীরে গিয়ে কাঁকড়া মারতে আর এতেই হয় দুর্ঘটনা। গ্রামের বয়স্ক গুরুজনেরা বলেন, ওরা তো নিয়ম মানে না। এত লোভ কেন? এই প্রশ্নের উত্তর কি শহরের মানুষের বিলাসিতা দিতে পারবে?

এ তো গেল সুন্দরবনের কথা। মধ্যপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, দক্ষিণ ভারত— জঙ্গল ছিন্নভিন্ন। উত্তর-পূর্ব ভারতে পামতেল চাষ নিঃশব্দে শেষ করছে ঘন সবুজ আচ্ছাদন, বন্যপ্রাণের নিরবচ্ছিন্ন আশ্রয়। দুনিয়াখ্যাত রণথম্ভোর জাতীয় উদ্যান দ্বীপসম। এই অবস্থা দেশের অনেক জাতীয় উদ্যানেরই। বাঘ ও বন্যপ্রাণের করিডরগুলি বিচ্ছিন্ন মানুষের আগ্রাসনে। সরকারি তথ্যে যে সবুজের আচ্ছাদন বেড়ে যাওয়ার খবর পাই, তাতে কৃষিজমির আলে লাগানো গাছকেও ধরা হয়। ওই বিশেষ বিশেষ দিনগুলিতে আমরা গাছ লাগানোর কথা বলি। গাছ লাগানো খুব ভাল। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল দেড়শো-দুশো বছরের পুরনো গাছগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা। বনভূমিকে উন্নয়নের নামে ধর্ষণ না করা।

বাঘের জঙ্গল বাঁচানো মানে কি শুধুই বাঘ বাঁচানো? যাঁরা তা বলেন, তাঁরা অজ্ঞ। বাঘের সুরক্ষার ছাতার তলায় এত বছর ধরে সুরক্ষিত থেকেছে অগণিত বন্যপ্রাণ প্রজাতি। এই নিয়ে কি কেউ সমীক্ষা করেছেন?

বাঘের সংখ্যা যদি বেড়ে থাকে, তার সঙ্গে তো পাল্লা দিয়ে কমছে তার বাসভূমি। চিরকালীন একসঙ্গে থাকা মানুষের সহনশীলতা। শুধু বাড়ছে জনসংখ্যা, বিলাসিতা, চাহিদা, আগ্রাসন। শূন্যে দাঁড়িয়েছে নীতি নির্ধারকদের বন্যপ্রাণ এবং বনভূমি সংরক্ষণের সদিচ্ছা। আর আমরা জনতা জনার্দন সব সমস্যার সমাধান করি এক নিমেষে একটা ‘ইমোজি’ দিয়ে। মোবাইলে প্রচুর গ্রুপ। সরব হই, একে অপরকে মৌখিক ভাবে আঘাত করি। কিন্তু কেউ চেষ্টা করি না সুন্দরবনের ওই মানুষগুলোকে একটা বিকল্প রোজগার দিতে।

আর এই এত প্রতিকূলতার মধ্যে দাঁড়িয়ে যাঁরা বাঘ ও বন্যপ্রাণ বাঁচানোর লড়াই চালিয়ে যান, তাঁরা হলেন সেই নিধিরাম সর্দারেরা— বন দফতরের মাঠে থাকা কর্মীরা। তাই বাঘ দিবসের শুভেচ্ছার পুরো কৃতিত্বই প্রাপ্য ওঁদের।

‘বাঘ দিবস’ বলে কিছু হয় না। অন্যান্য বন্যপ্রাণের সঙ্গে বাঘও লড়ছে মানুষের ভোগবাদের বিরুদ্ধে।

(লেখক রাজ্য বন্যপ্রাণ উপদেষ্টা পর্যদের সদস্য। মতামত নিজস্ব)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন