ঘর গোছানোর কাজ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দাবি করে

দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে হিন্দিকে হিন্দিতে ‘রাজভাষা’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। ফলে দেশের অসংখ্য মানুষ এখনও ভুলবশত একে ‘রাষ্ট্রভাষা’ মনে করেন। লিখছেন দেবোত্তম চক্রবর্তীএই ফাঁকে গত ১৪ সেপ্টেম্বর ‘হিন্দি ভাষা দিবস’ উপলক্ষে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আবারও হিন্দির হয়ে সওয়াল করেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই এই আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে দেশের অসংখ্য শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ গর্জে উঠেছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:৩৪
Share:

গত জুন মাসে কেন্দ্রীয় সরকার ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’-র খসড়ায় বিদ্যালয় স্তরে হিন্দিকে বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব উত্থাপন করলেও মূলত দক্ষিণ ভারত, বিশেষত তামিলনাড়ুর জোরালো আপত্তিতে সেই প্রস্তাব আপাতত স্থগিত। এই ফাঁকে গত ১৪ সেপ্টেম্বর ‘হিন্দি ভাষা দিবস’ উপলক্ষে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আবারও হিন্দির হয়ে সওয়াল করেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই এই আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে দেশের অসংখ্য শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ গর্জে উঠেছেন।

Advertisement

সরকারি ক্ষেত্রে হিন্দিকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার এই নীতি আজকের নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই এই বহুজাতিক বহুভাষিক যুক্তরাষ্ট্রটিকে একজাতিক একভাষিক রাষ্ট্রে পরিণত করার অপপ্রয়াস চালু হয়। এতৎসত্ত্বেও সংবিধান প্রণয়নের প্রায় পনেরো বছর পরও সেই প্রক্রিয়া ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি।
পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু এবং অন্য দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য সমূহের ধারাবাহিক বিরোধিতার ফলে ১৯৬৩ সালে ‘রাজভাষা অ্যাক্ট’ পাস হয়। এই আইন অনুযায়ী সংবিধানের ‘রাষ্ট্রভাষা’র প্রস্তাবিত অংশটি বাতিল হয় এবং হিন্দির সঙ্গে ইংরেজিকে ভারতের দাপ্তরিক বা ‘অফিসিয়াল’ ভাষা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। বর্তমান ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী “Hindi or English is used in official purposes such as parliamentary proceedings, judiciary, communications between the Central Government and a State Government”।

দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে হিন্দিকে হিন্দিতে ‘রাজভাষা’ হিসাবে চিহ্নিত করার ফলে দেশের অসংখ্য মানুষ এখনও ভুলবশত একে ‘রাষ্ট্রভাষা’ মনে করেন। এই ভুলকে হাতিয়ার করে কেন্দ্রীয় সরকারি বিভিন্ন প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষায় ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি হিন্দিতে প্রশ্নপত্র ছাপানো, সরকারি অফিস এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অনুমোদনপ্রাপ্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে ইংরেজি ও হিন্দি ভাষায় ফর্ম ছাপানো, দূরদর্শনের জাতীয় কার্যক্রমে কেবল মাত্র ইংরেজি ও হিন্দি ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার, কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষার্থীদের আঞ্চলিক ভাষাশিক্ষার সুযোগ প্রায় না থাকা— বিভিন্ন ভাবে জনজীবনে হিন্দিকে চাপিয়ে দেওয়ার এই সুচিন্তিত প্রবণতা অত্যন্ত মারাত্মক।

Advertisement

কিন্তু ভাষা আগ্রাসনের আলোচনাটিকে শুধু মাত্র কেন্দ্রীয় স্তরেই সীমাবদ্ধ রাখলে তা একমাত্রিক হতে বাধ্য। কেন্দ্র অবশ্যই দোষী, কিন্তু অভিযোগের তর্জনী অন্যের দিকে তুলতে গেলে মধ্যমা-অনামিকা-কনিষ্ঠার অভিমুখ যে নিজের দিকেই থাকে, তা ভুলে যাওয়া উচিত নয়। বিদ্যালয় স্তরে ভাষাশিক্ষার সঙ্গে দীর্ঘ ২৯ বছর প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত থাকার সুবাদে, এক জন সামান্য শিক্ষক হিসাবে এই রাজ্যেও ভাষা ক্ষেত্রে আগ্রাসনের বিষয়টি তুলে ধরতে চাই।

বিখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় নির্ধারিত মান্য চলিত বাংলার সংজ্ঞা অনুযায়ী, নবদ্বীপ-শান্তিপুরের কথ্য বাংলাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে এ রাজ্যে পাঠ্যপুস্তক ছাপা হচ্ছে দীর্ঘ দিন ধরে। তড়িঘড়ি করে এই ব্যবস্থা পাল্টানো অসম্ভব এবং অনুচিত। অথচ, কোচবিহার, মেদিনীপুর, পুরুলিয়া এবং মুর্শিদাবাদের মতো নানা জেলার অসংখ্য মানুষের কাছে এই বহুপ্রচলিত ‘মান্য’ বাংলা প্রায় দ্বিতীয় ভাষার সমতুল। ফলে, দীর্ঘ দিন ধরে রাজ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অজস্র শিক্ষার্থী জীবনের প্রথম দিন থেকেই বিদ্যালয়ে তিনটে ভাষা শিখতে বাধ্য হচ্ছে।

এই রাজ্যেই এমন অনেক শহর আছে যেখানে কোনও হিন্দি মাধ্যম বিদ্যালয় নেই। অথচ, সেই শহরগুলিতে অগণিত সাফাইকর্মী, মোটবাহক, চর্মশিল্পী, ধুনুরি আছেন যাঁদের মাতৃভাষা বাংলা নয় এবং যাঁরা বাড়িতে বাংলা বলেন না। এঁদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে প্রথম ভাষা এবং দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে যথাক্রমে বাংলা ও ইংরেজি নেওয়া বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ, প্রথম শ্রেণি থেকেই এই ছাত্রছাত্রীদেরও বাধ্যতামূলক ভাবে তিনটে ভাষা শিখতে হচ্ছে। কিন্তু এই ভাষা আগ্রাসনের ব্যাপারে আমরা নিয়ত নীরব ও সতত উদাসীন।
এই শ্রেণিগত আগ্রাসন ছাড়াও আছে মাধ্যমগত আগ্রাসন। পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অধীনে ছাত্রছাত্রীদের বাংলা, হিন্দি, উর্দু, নেপালি এবং সাঁওতালি মাধ্যম বিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ আছে। এই মাধ্যমগুলির শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে ইংরেজি নেওয়া বাধ্যতামূলক এবং এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত যুগোপযোগী ও যুক্তিযুক্ত। সেই হিসাবে বাংলা মাধ্যম ছাড়া অন্য মাধ্যমের ছেলেমেয়েদের ইচ্ছা থাকলেও সরকারি নিয়মেই বাংলা পড়ার সুযোগ নেই এবং এদের সংখ্যাটা খুব কম নয়।

এখানেই শেষ নয়। পর্ষদের পড়ুয়াদের প্রথম ভাষা হিসেবে বেছে নেওয়ার সুযোগ আছে বাংলা, ইংরেজি, গুজরাটি, হিন্দি, আধুনিক তিব্বতি, নেপালি, ওড়িয়া, গুরুমুখী, সাঁওতালি, তেলুগু, তামিল এবং উর্দু-সহ মোট ১২টি ভাষার যে কোনও একটিকে। অর্থাৎ, যে সব পড়ুয়া বাংলা বা ইংরেজিকে প্রথম ভাষা হিসেবে নিতে ইচ্ছুক নয়, বিদ্যালয় স্তরে তাদের আর বাংলা ভাষা পড়ার সুযোগ নেই। অথচ, এই ব্যাপারে আমরা শুধু নির্বিকারই নই, নিরুত্তাপও বটে।

ভাষা ক্ষেত্রে আগ্রাসনের ব্যাপারে সত্যি সতি আশঙ্কিত হলে নিজের ঘর গোছানোর কাজটা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দাবি করে। বাংলার ছেলেমেয়েদের মাধ্যম ও প্রথম ভাষা বেছে নেওয়ার দেদার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। অথচ, রাজ্যের বাসিন্দারা পর্ষদ অনুমোদিত বিদ্যালয়ে পড়েও বাংলা ভাষা পড়া ও লেখার সুযোগ থেকে দীর্ঘ দিন বঞ্চিত হচ্ছেন। এই ব্যাপারে অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত না নিলে শুধুমাত্র হিন্দিভাষার আগ্রাসন নিয়ে চিন্তাভাবনা বিশুদ্ধ ‘ভাবের ঘরে চুরি’ মনে হতে বাধ্য।

লেখক: আমঘাটা শ্যামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন