কোভিড-১৯ কোন দিকে যাবে, কেমন হবে মানুষের হাল, তা নিয়ে ফেব্রুয়ারি থেকে প্রায় প্রতি সপ্তাহে বিশেষজ্ঞরা আগাম জানান দিচ্ছেন। আর আমরাও দেখে যাচ্ছি যে, তার অধিকাংশই মিলছে না। যে নীতি কোটি কোটি মানুষের জীবন নির্ধারণ করে, কী করে তা স্থির হয়, সেই প্রশ্নটা তাই বার বার মাথা চাড়া দিচ্ছে।
‘বিশেষজ্ঞের মতামত’-এর উপর নির্ভর করেই নীতি স্থির করছে দেশগুলো। ব্রিটেনে ইম্পিরিয়াল কলেজের মহামারি বিশারদ নিয়েল ফার্গুসন মার্চ মাসে বললেন, ব্রিটেনে পাঁচ লক্ষ লোক কোভিডে প্রাণ হারাবেন। তাঁর কথার দৌলতে ব্রিটেনে তালাবন্দি শুরু হয়ে গেল। পরে তাঁর গবেষণার রিপোর্ট বিজ্ঞানীদের হাতে এলে অনেকেই সেটির নিন্দা করেন। ফার্গুসনের মডেল অনুযায়ী প্রমোদতরীতে প্রায় সাতশো যাত্রীর কোভিড সংক্রমণ ধরা পড়েছিল, সেখানে ষাট থেকে আশি জনের মৃত্যু হবার কথা ছিল। বাস্তবে মারা গিয়েছেন সাত জন। এই ভুল দেখান স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ মাইকেল লেউইট। মহামারি বিশারদদের হিসেব নিয়ে প্রথম প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনিই।
ইউরোপ-আমেরিকার সমস্ত দেশের করোনার মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করে লেউইট দেখাচ্ছেন, যাদের বাঁচানোর জন্য সারা বিশ্বের অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে, তাদের সত্তর শতাংশের বয়স ৭০ বছরের বেশি। আর দুনিয়া জুড়ে শিক্ষা, পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও জীবিকাহীন হয়ে যারা বিপর্যস্ত, তারা বয়সে নবীন। ভারতে যে নয় কোটি মানুষ এপ্রিল-মে মাসে কাজ হারিয়েছেন, তাদের বয়স ২০-৪৫ বছরের মধ্যে। আড়াই মাস বন্ধ ছিল শিশুদের টিকাকরণ, এখনও সর্বত্র চালু হয়নি।
করোনাভাইরাস মহামারি রূপে দেখা দেওয়ার পর ছয় মাস অতিক্রান্ত। সংক্রমণ প্রতিরোধের নীতি নিয়ে এখন নানা প্রশ্ন উঠছে। একটা প্রশ্ন নীতির ভিত্তি নিয়ে। যে কোনও বিজ্ঞানের বেশির ভাগ শাখায় কোনও দাবির সঙ্গে বাস্তবের ফারাক যদি দশ-বিশ শতাংশের বেশি হয়, তা হলে ঢি-ঢি পড়ে যায়। এখন দেখা যাচ্ছে যে মহামারিবিদ্যা (এপিডেমিয়োলজি) এমনই এক নির্লজ্জ বিজ্ঞান, যে বার বার একশো গুণ ভুল হলেও কেউ দুঃখ প্রকাশ করে না। সেই সঙ্গে রয়েছে বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশনের ঝোঁকও। যেমন, করোনা সংক্রমণ দ্বিগুণ হল কত দিনে, সেই হিসেব। বলা হচ্ছে, ভারতে দ্বিগুণের হার ১২-১৩ দিন, ইউরোপের প্রায় সব দেশে ৩০ দিনের বেশি। কিন্তু ইউরোপের দেশে মৃত্যুহার অনেক বেশি। প্রতি দশ লক্ষ জনসংখ্যায় ব্রিটেনে ৬১০, স্পেনে ৫৮১, ইতালিতে ৫৬২। ভারতে সে তুলনায় অনেক কম।
মানুষের প্রাণ অমূল্য। লকডাউন বহু মানুষের প্রাণ বাঁচাতে পারে, এই আশায় এতগুলো দেশ লকডাউন নীতি গ্রহণ করেছে। উদ্দেশ্য উত্তম, কিন্তু কতটা কার্যকর? সুইডেন তো আদৌ লকডাউন করেনি, সেখানে প্রতি দশ লক্ষ জনসংখ্যায় ৯ জুন পর্যন্ত মারা গিয়েছেন ৪৬১ জন। বেলজিয়াম দু’মাস লকডাউন করেও মৃত্যুর হারে সবার উপরে, দশ লক্ষে ৮০০ জন। দক্ষিণ কোরিয়ায় ন্যূনতম লকডাউন সত্ত্বেও মৃত্যুর সংখ্যা দশ লক্ষে মাত্র ৫। লকডাউন করে ভারতে সংখ্যাটা ৬, চিনে ৩। অনেকে মনে করছেন, সংক্রমণ কতটা বাড়বে, সেটা লকডাউনের চেয়ে বেশি নির্ভর করে বয়স, নমুনা পরীক্ষার হার, পরস্পর দূরত্ব রক্ষা, মাস্ক ব্যবহারের উপর।
ভারত প্রসঙ্গে আরও একটা প্রশ্ন উঠছে। ২০১৮-২০১৯ সালে যক্ষ্মায় ভারতে চার লক্ষেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, আক্রান্ত ২৮ লক্ষ। যক্ষ্মাও ছড়ায় হাওয়ায়-ভাসা থুতুর মাধ্যমে, হাঁচি-কাশি বা কথা থেকে। সংক্রমণ বন্ধ করতে লকডাউনের জন্য কেউ কখনও সওয়াল করেনি কেন? সার্স বা বার্ড ফ্লু ছড়ানোর সময়ও নয়। তা হলে কোভিড-এর জন্য এই কর্মনাশা সর্বাত্মক লকডাউন কেন?
ব্রিটেনের বিশেষজ্ঞ কার্ল ফ্রিস্টোন আশিটি দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখাচ্ছেন, লকডাউন প্রভৃতি সরকারি প্রচেষ্টার প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। শরীরের প্রতিরোধশক্তিই যা করার করছে। মহামারি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে প্রায় একই সুরে কথা বলেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনেত্রা গুপ্ত, আর ভারতে ভেলোর ক্রিশ্চান কলেজের জয়প্রকাশ মুলিয়েল। তাঁরা হিসেব করে দেখাচ্ছেন যে করোনার গতিবিধি অন্য ভাইরাসের মতো। সংক্রমণের গোষ্ঠী প্রতিরোধ (হার্ড ইমিউনিটি) তৈরির কথাই ভাবতে হবে।
নানা মত সামনে আসছে, আরও আসবে। শুনতে হবে গুরুত্ব দিয়ে। তবে নীতি প্রণয়নের পুরনো শিক্ষাটি মনে রাখতে হবে। সব থেকে খারাপ পরিণাম কী হতে পারে, সেই সম্ভাবনা দিয়ে নীতি প্রণয়ন ঠিক নয়। স্থির করতে হবে, কোন বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, কোন স্বার্থ সুরক্ষিত রাখা দরকার। এই জন্য মহামারি বিশারদ, জনস্বাস্থ্যবিদ, অর্থনীতিবিদ, প্রশাসক এবং রাজনীতিকদের এক টেবিলে বসতে হয়। নানা মত শোনার ও খোলামেলা বিচারের প্রক্রিয়াটি জরুরি। তাতে ভুল হওয়ার, বড় ক্ষতির সম্ভাবনা কমে।
স্কুল অব ডেভেলপমেন্ট, আজিম প্রেমজি ইউনিভার্সিটি