প্রতিশ্রুতির পর ফের যে কে সেই

সকাল-বিকেল রাউন্ডের পর সিনিয়র ডাক্তারদের রোগীর পরিজনদের সঙ্গে দেখা করার কথা। কিন্তু অধিকাংশ চিকিৎসক এই পেশেন্ট মিট করতে চান না।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৯ ০০:১৬
Share:

খাতায়-কলমে কত চমৎকার পরিকল্পনা তৈরি হয়! যেমন হল মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে জুনিয়র ডাক্তারদের বৈঠকে। নজিরবিহীন সঙ্কটের ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’ হল নিরাপত্তার পরিকল্পনা দিয়ে। কী করে তার রূপায়ণ হবে, তা নিয়ে স্বাস্থ্য ভবন ও পুলিশ বৈঠক করছে দফায় দফায়।

Advertisement

এটা বাইরের খবর। ভিতরের খবর, স্বাস্থ্য কর্তারা অতীতে এমন অনেক দেখেছেন। তাঁরা জানেন, ক’মাস নজরদারি বৈঠক হবে, রিপোর্ট পাঠানো, ভিডিয়ো কনফারেন্স চলবে। ছ’সাত মাস কোনও গোলমাল না হলে নতুন বিধিও শিকেয় উঠবে। নিকট অতীতে রোগী পরিষেবা নিয়ে ওঠা অভিযোগ মেটাতে বা হাসপাতালের নিরাপত্তা রক্ষায় বহু নিয়ম চালু হয়েছিল। সে সব আজ কোথায়?

যেমন অন্য হাসপাতাল ‘রেফার’ করতে হলে রোগীর নথিভুক্তির নিয়ম। তৃণমূল সরকার রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরে সঞ্জয় মিত্র যখন রাজ্যের স্বাস্থ্য সচিব তখন এই রেফারাল রেজিস্ট্রি ও রেফারাল অডিট চালু হয়। অত্যন্ত অসুস্থ, বা আহতকে হাসপাতাল অন্যত্র নিয়ে যেতে বললে উৎকণ্ঠিত পরিজন স্বাভাবিক ভাবেই মেজাজ হারান। তিন-চারটি হাসপাতালে রেফার হতে-হতে মৃত্যুর অজস্র খবর শোনা যায়। এটা বন্ধ করতে স্থির হয়েছিল, গুরুতর অসুস্থ রোগীকে রেফার করতে হলে হাসপাতালই অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা করবে। অন্য হাসপাতালে ফোন করে শয্যা নিশ্চিত করবে। রেজিস্ট্রি খাতায় রোগীর নাম ও রেফার করার কারণ নথিভুক্ত করবে। প্রতি মাসে খাতা পরীক্ষা করবেন কর্তারা। আজ? রেজিস্ট্রি খাতা নিখোঁজ অধিকাংশ হাসপাতালে, দেদার রেফার চলছে মুখে-মুখে।

Advertisement

স্বাস্থ্য ভবন একাধিক বার নির্দেশ জারি করেছে, এক মেডিক্যাল কলেজ থেকে অন্য মেডিক্যাল কলেজে রোগী রেফার করা যাবে না, কারণ, দু’জায়গাতেই পরিকাঠামো একই রকম। নিয়ম রয়েছে, সাধারণ অসুখের রোগীকে মেডিক্যাল কলেজ স্তরে ভর্তি করে চিকিৎসা করা যাবে না। কারণ, মেডিক্যাল কলেজ ‘সুপার স্পেশালিটি’ চিকিৎসার জায়গা। সেখানে রোগীদের মাত্র পাঁচ শতাংশের চিকিৎসা হওয়ার কথা। কিন্তু কে শুনছে? নীলরতনে কর্মবিরতির সময়ে এমন বহু রোগীর দুর্ভোগ খবরে উঠে এল, যাঁদের জেলাতেই চিকিৎসা পাওয়ার কথা। ২০১৫’য় অযৌক্তিক রেফারে বিরক্ত হয়ে এসএসকেএম কর্তৃপক্ষ ঠিক করেন, কোন কোন হাসপাতাল অযৌক্তিক রেফার করেছে, তার ‘ফাইল’ যাবে স্বাস্থ্য ভবনে। সে ফাইলও ভ্যানিশ।

মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায়ই সকালের দিকে সরকারি হাসপাতাল ঘুরে দেখতেন। তখনই আউটডোরে রোগীদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার কথা তিনি জানতে পারেন। দশটা-এগারোটা বেজে যায়, ‘বড় ডাক্তার’ আর আসেন না। রোগীরা ক্লান্তিতে নুয়ে পড়ছেন। তিন-চার ঘণ্টা লাইনে থাকার পর শুনতে হচ্ছে, ‘‘দুটো বেজে গিয়েছে, আজ আর দেখা হবে না।’’

২০১৪-১৫ নাগাদ নিয়ম হয়, প্রতি হাসপাতালের সুপার সকাল ৯টায় হাসপাতালে গিয়ে দেখবেন, কোন কোন আউটডোর খোলেনি। নিয়মিত যাঁরা দেরি করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করবে স্বাস্থ্য দফতর। সে নিয়মও উঠে গিয়েছে।

কয়েক দিন আগে জুনিয়র ডাক্তারদের বিক্ষোভের পর যে নিয়মগুলি চালু করার পরিকল্পনা হচ্ছে, তার মধ্যে কয়েকটি আগেও চালু হয়েছিল। নীলরতন, মেডিক্যাল কলেজ ও ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে পর পর রোগী মৃত্যুর ঘটনায় জুনিয়র ডাক্তারদের মারধরের অভিযোগ ওঠে ২০১৬-১৭ সাল নাগাদ। প্রতিবাদে কর্মবিরতিও হয়। তখনই হাসপাতাল চত্বরে বাইরের গাড়ি না রাখা, ইমার্জেন্সি বা ওয়ার্ডে রোগীর সঙ্গে দু’জনের বেশি লোক না ঢোকার মতো নিয়মগুলি চালু হয়। কিন্তু সে সব নিয়মও বেশি দিন চলেনি।

চিকিৎসক ও চিকিৎসা-কর্মীদের নির্দিষ্ট পোশাকে হাসপাতালে আসার নিয়মও হয়েছিল, যাতে বহিরাগতদের চিহ্নিত করা যায়। তা-ও কেউ মানেননি। হাসপাতালে অভিযোগ জানানোর বাক্স বসেছে। স্বাস্থ্য ভবনে অভিযোগ জানানোর নম্বর রয়েছে। সেটা ক’জন জানেন? সে সব অভিযোগের ভিত্তিতে ক’টা তদন্ত হয়েছে? চিকিৎসক-রোগী বিবাদের নিষ্পত্তির উপায় হিসেবে হাসপাতালে ‘হেল্প ডেস্ক’ চালু হয়েছিল। এখন অধিকাংশ সময়ে সেখানে কারও দেখা মেলে না। যেমন জানা যায় না, অকারণ ওষুধ লেখা আটকাতে ২০১৭-১৮ নাগাদ আউটডোরে যে প্রেসক্রিপশন ‘অডিট’ চালু হয়েছিল, তা এখনও চালু আছে কি না।

সকাল-বিকেল রাউন্ডের পর সিনিয়র ডাক্তারদের রোগীর পরিজনদের সঙ্গে দেখা করার কথা। কিন্তু অধিকাংশ চিকিৎসক এই পেশেন্ট মিট করতে চান না। রোগীর ঠিক কী হয়েছে, কেমন আছে— চিকিৎসকদের থেকে এইটুকু জানতে নাজেহাল হতে হয় মানুষকে। যন্ত্রণায় ছটফট করা রোগীর উদ্বিগ্ন আত্মীয় যখন ওয়ার্ডে বসে-থাকা নার্সের কাছে দৌড়ে যান, তাঁকে নির্লিপ্ত গলার উত্তর শুনতে হয়, ‘‘ঠিক আছে। ডাক্তার এলে বলবেন।’’ ওষুধের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, স্যালাইনের নলে রক্ত ঢুকে যাচ্ছে, রোগী বমি করছে— উত্তর আসবে, ‘‘আপনি তো বাড়ির লোক? দেখে নিন।’’

এই ভাবে গোটা সমাজে সরকারি হাসপাতাল সম্পর্কে প্রবল নেতিবাচক ধারণা, অবিশ্বাস গড়ে ওঠে। মনে হতে থাকে, ওখানে সব খারাপ, সবাই খারাপ। স্পর্শকাতর মুহূর্তে ঘটে চরম বিস্ফোরণ। ক্ষোভের আগুন নেভাতে প্রতিশ্রুতির বন্যা বয়ে যায়, তার পর ফের যে কে সেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন