শ্যামলাল বিশ্বাস, অনন্ত বিশ্বাস, সুবল বিশ্বাস, অবিনাশ বিশ্বাস ও ধনঞ্জয় নমশূদ্র। লুইত নদীর পারে গত ১ নভেম্বর সন্ধেয় অজ্ঞাত আততায়ীর কালাশনিকভের গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে যাওয়া পাঁচটি মানুষ মৃত্যুর আগে জেনে যেতে পারলেন না, এই রাজ্যের কী ক্ষতি তাঁরা করেছিলেন। অনতিদূরেই বৃদ্ধ লুইতের বিস্তীর্ণ দু’পারকে সম্প্রীতির বাঁধনে বেঁধেছে কালজয়ী ভূপেন হাজরিকার নামাঙ্কিত ধলা-শদিয়া সেতু। নয় কিলোমিটার ১৫০ মিটার লম্বা, দেশের দীর্ঘতম সেতু। সেই ষাটের দশকে লুইতের কাছেই যাবতীয় অনুযোগ আর অভিযোগ জানিয়ে তিনি গেয়েছিলেন: ‘‘বিস্তীর্ণ পাররে/ অসংখ্য জনরে/ হাহাকার শুনিয়ো/ নিঃশব্দে নীরবে/ বুঢ়া লুইত তুমি/ বুঢ়া লুইত বোঁয়া কিয়?’’ এর পর চার দশকে লুইত দিয়ে গড়িয়েছে অনেক জল।
এই মুহূর্তে পুলিশ কেন্দ্রীয় বাহিনী ও সেনারা খুঁজে বেড়াচ্ছে আততায়ীদের। কিন্তু আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বোধ হয় ‘কে মারল’ নয়, আমরা জানতে চাই কেন মারল? মৃতরা সবাই একটি নির্দিষ্ট ভাষায় কথা বলতেন। এবং তাঁদের সবার ধর্ম ছিল এক। এই দু’টি পরিচিতি তাঁরা নিজেদের জন্য সৃষ্টি করেননি, বহন করেছিলেন মাত্র। আমরা আমাদের মতো করে তাঁদের উপর পরিচিতি চাপিয়ে দিয়েছিলাম। অমর্ত্য সেন আইডেন্টিটি অ্যান্ড ভায়োলেন্স: দি ইলিউশন অব ডেস্টিনি (২০০৬) বইতে এই চাপিয়ে দেওয়া পরিচিতির বিরুদ্ধে জোর সওয়াল করেছিলেন।
রাজনীতির কারবারিদের কাছে পরিচিতি আরোপের এই খেলা খুব প্রয়োজনীয়। এক-একটি আরোপিত পরিচিতি থেকেই তো ভোটব্যাঙ্কগুলোর সৃষ্টি হয়। ধরেই নেওয়া হয় যাদবরা লালুপ্রসাদকেই ভোট দেবেন, দলিতদের আনুগত্য থাকবে মায়াবতীর প্রতি, ব্রাহ্মণরা বিজেপিতে অনুরক্ত থাকবেন, অসমের মুসলমানরা এইউডিএফ-কেই রাজনৈতিক আশ্রয় হিসেবে মেনে নেবেন।
স্বাধীনতা-উত্তর অসমের রাজনীতি বরাবরই ভাষিক-সাংস্কৃতিক পরিচিতিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। এবং অসমিয়া জাতীয়তাবাদ হচ্ছে সেই আবর্তের অভিকেন্দ্র। দূর অতীতের দুটো ঘটনা— ১৮৩৭ সালে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত অসমে বাংলাকে ইংরেজ শাসকরা সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। ১৮৭৪ সালে বাঙালি-প্রধান কাছাড়, সিলেট ও গোয়ালপাড়া জেলাকে জুড়ে দিয়ে চিফ কমিশনার-শাসিত অসম প্রদেশ তৈরি হয়— বাঙালিকে অসমিয়া ভাষা, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচিতির বৈরীপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। ১৮৭৩-এ বাংলাকে সরিয়ে অসমিয়া ভাষাকে স্ব-মর্যাদার আসনে ফিরিয়ে আনা হয়। শিবনাথ বর্মণ, প্রসেনজিৎ চৌধুরীদের গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, বাংলাকে সরকারি ভাষা এবং শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালু করার পিছনে বাঙালিদের কোনও ‘ষড়যন্ত্র’ই ছিল না। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীতে নব্য-অসমিয়া বুদ্ধিজীবীকুল বাংলা ভাষার যে ‘আধিপত্য’ দেখেছিলেন তা থেকে আজকের অসমের মধ্যবিত্তরাও মুক্ত হতে পারেননি। অনুরূপ ভাবে, তিন তিনটি বাংলাভাষী জেলার অন্তর্ভুক্তিতে অসমিয়ারা সংখ্যালঘু হয়ে গিয়েছিলেন। সিলেটকে পাকিস্তানে ঠেলে দেওয়ার পরও এবং পূর্ব বাংলা থেকে অভিবাসিত মুসলমান খেতমজুররা নিজেদের ভাষিক পরিচিতি অসমিয়া হিসেবে ঘোষণা করা সত্ত্বেও নিজ ‘দেশ’-এ সংখ্যায় হীনবল হওয়ার আতঙ্ক থেকে অসমিয়া জাতীয়তাবাদ কখনওই বেরিয়ে আসতে পারেনি।
পূর্ব-পাকিস্তান এবং পরবর্তী কালে বাংলাদেশ থেকে দলে দলে লোক এসে অসমিয়া ভাষা সংস্কৃতি এবং অর্থনীতি বিপন্ন করে দিচ্ছে— এই আতঙ্ক থেকেই অসম আন্দোলন হয়েছিল। বাংলাদেশ থেকে যাঁরাই সীমান্ত পেরিয়ে অসমের ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করবেন, তাঁরা তো সবাই বাংলায় কথা বলা মানুষ। ফলে বাংলাভাষী মাত্রেই সন্দেহের আবর্তে ঢুকে যাবেন। ‘বিদেশি বিতাড়নের আন্দোলন’ তাই কার্যত বাঙালি-বিরোধী আন্দোলনেরই চেহারা নেয়।
বিগত তিন বছরে নাগরিকত্ব বিলকে জড়িয়ে যে রাজনীতির উত্থান আমরা দেখেছি তাতেই রাজ্যের সামাজিক পরিস্থিতি জটিল চেহারা নিয়েছে। ভাষা-সাম্প্রদায়িকতা এবং ভাষিক জাতীয়তাবাদ অসমের রাজনীতির পদচিহ্ন। কিন্তু ধর্মীয় বিভাজন এতে ছিল না। রাজ্যের বাংলাভাষী হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সন্দেহভাজন বাংলাদেশি— এই সামাজিক বয়ানে (সোশ্যাল ন্যারেটিভ) অসম অভ্যস্ত ছিল। বস্তুত, এটাই ছিল বরাবরের আরোপিত পরিচিতি। কিন্তু আরএসএস-বিজেপির রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা অভিবাসীদের ধর্মীয় পরিচিতির নিরিখে দুই ভাগ করল। হিন্দু বাঙালিরা শরণার্থী এবং মুসলমান বাঙালিরা অনুপ্রবেশকারী— এই তত্ত্বের ভিত্তিতে ২০১৫’র সেপ্টেম্বরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বিজ্ঞপ্তি জারি করল, ২০১৬’র জুলাইয়ে বাদল অধিবেশনে লোকসভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পেশ করল সরকার। ১৯৭১-এর ২৪ মার্চ মধ্যরাত পর্যন্ত হিন্দু মুসলমান জৈন বৌদ্ধ শিখ খ্রিস্টান যাঁরাই অসমে এসেছেন, অসম চুক্তি মতে তাঁরা সবাই ভারতীয়। এনআরসি নবায়ন প্রক্রিয়ার বেলায়ও ওই অসম চুক্তি-নির্দিষ্ট তারিখ ধরেই নাগরিকত্ব নিরূপণ হচ্ছে। অসম চুক্তি এবং এনআরসি, এই দু’টি বিষয়েই কিন্তু অসমে সামাজিক-রাজনৈতিক ঐকমত্যের জায়গা তৈরি ছিল। বলা যায়, একটা সামাজিক ভারসাম্যও বজায় ছিল। কিন্তু বিজেপির বিল সেই ভারসাম্যকে আঘাত করেছে।
‘হিন্দু বাঙালি’ নামে নতুন শব্দবন্ধ ব্যবহার করে আরোপিত পরিচিতি তৈরি হয়েছে। এই পরিচিতি এঁদের গণশত্রু হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। ধরেই নেওয়া হচ্ছে, হিন্দুধর্মাবলম্বী বাঙালি মাত্রেই অসমে নাগরিকত্ব বিলকে সমর্থন করছেন। অসমিয়া, বাঙালি হিন্দু, মুসলমান— নানা পরিচয়ে শতধাবিভক্ত হয়ে এক অবিশ্বাসের বাতাবরণে সবাই ঢুকে গিয়েছেন।
হত্যালীলার প্রতিবাদে আহূত বারো ঘণ্টার অসম বন্ধে দেখলাম, বাঙালি এলাকায় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়েছে। অন্যান্য অঞ্চলে প্রভাব পড়েনি। এখানেই শেষ নয়, সঙ্ঘ পরিবার আশ্রিত সংগঠনগুলি ‘ভারতীয় হিন্দু বাঙালি’ নিধনের বিরুদ্ধেই বন্ধ ডেকেছিল। মৃতদেহের ধর্ম ভাষা ও নাগরিকত্ব দেখে শোকপালন এবং প্রতিবাদ সাব্যস্ত করার এই ধরন আমাদের শিহরিত করে। হৃদয়হীন সমাজের সদস্য হিসেবে আমরা বিমূঢ় হই। বুঝতে পারি যে, নিরপরাধ ওই পাঁচটি মানবসন্তানের মৃত্যুর কারণ তাঁদের পরিচিতি, যা তাঁরা নিজেরা বেছে নেননি। নাগরিকত্ব বিলের তাঁদের প্রয়োজন ছিল না, এনআরসিতে তাঁদের নাম ছিল। তবুও তাঁদের মরতে হল। কেন? জবাব দেয় না প্রবৃদ্ধ লুইত!
শিলচরে কাছাড় কলেজে অর্থনীতির শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত