অনেক দিনের সংগ্রাম স্বীকৃতি পেল

পয়লা জানুয়ারি থেকে আসানসোল পুরসভা এলাকায় বাণিজ্যিক সংস্থার সাইনবোর্ডে বাংলায় লেখা বাধ্যতামূলক করা হল। আসানসোল পুরসভা তাদের দায়বোধ সুচারু ভাবে পালন করল। এখন আমাদের সচেতন হওয়ার সময়। লিখছেন অরুণাভ সেনগুপ্ত

Advertisement

অরুণাভ সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৯ ০১:৪৩
Share:

পাল্টাবে পরিস্থিতি। বাংলা ভাষায় লেখা হবে সাইনবোর্ড। নিজস্ব চিত্র

আর দু’দিন বাদে নতুন বছর শুরু হচ্ছে। এই নতুন বছর আসানসোলবাসীদের জন্য এক নতুন সুখবর বয়ে নিয়ে আসছে। পয়লা জানুয়ারি থেকে আসানসোল পুরসভা এলাকায় বাণিজ্যিক সংস্থার সাইনবোর্ডে বাংলায় লেখা বাধ্যতামূলক করা হল। মেয়র জিতেন্দ্র তিওয়ারির মুখে পুরসভার এই সিদ্ধান্তের কথা শুনে সকলেই সাধুবাদ জানিয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন সাহিত্য-সংস্কৃতি সংগঠন ও মননশীল বাসিন্দাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে পুরসভার এই সময়োচিত সিদ্ধান্ত প্রশংসার দাবি রাখে।

Advertisement

এই প্রসঙ্গে উঠে আসে আসানসোল শিল্পাঞ্চলে বাংলাভাষার অবস্থানের কথা। তা যে মোটেই গৌরবজনক নয়, তা সংশ্লিষ্ট সকলেই স্বীকার করবেন। বস্তুত, বাংলা ভাষার প্রতি গুরুত্বদানের অভাবেই এই সিদ্ধান্ত সংক্রান্ত প্রেক্ষিতটি তৈরি করেছিল। সহজেই নজরে আসে, আসানসোল শিল্পাঞ্চলের রাস্তাঘাটে, দোকানবাজারে সংলাপে যে ভাষাটি জায়গা পায়, আক্ষেপের কথা, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাংলা নয়। অবাঙালিরা নিজেদের মধ্যে তাঁদের ভাষায় কথা বলবেন, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁদের অনুযোগ, তাঁরা বাংলা বলতে চাইলেও শিল্পাঞ্চলের বাঙালিরা তাঁদের (অবাঙালিদের) ভাষাতেই কথা বলতে উৎসাহী, অপটু লবজে হলেও। এই পরিস্থিতিতেই হয়তো দেখি, অবাঙালিদের সেই প্রজন্ম, যাঁরা গত তিরিশ বছরের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং বড় হয়েছেন এই শিল্পাঞ্চলে, তাঁরা বাংলাভাষায় কথা বলা শিখে উঠতে পারেননি। এটি এই লেখকের চিকিৎসক পেশার অভিজ্ঞতার নির্যাস। আর নতুন প্রজন্মের বাঙালি যুবার মুখে যা খইয়ের মতো ফোটে তা-ও বাংলা নয়, অথবা তা এক খিচুড়ি ভাষা।

আবার কর্পোরেট অফিস অথবা কেতাদুরস্ত হোটেল বা রেস্তরাঁ, যেগুলি তথাকথিত ‘সম্ভ্রান্ত’, সেখানেও দেখা যায়, কথা শুরু বা চালানোর ক্ষেত্রে আমাদের মাতৃভাষা ব্রাত্য হয়েই থাকছে। সেটি হীনমন্যতা থেকে নাকি ঔপনিবেশিক হ্যাংওভার-এর ফসল জানা নেই। নিজের অভিজ্ঞতায় দেখা কেতাদুরস্ত হোটেলে আমার কাছের টেবিলে বাঙালি সুজন বাঙালি ওয়েটারের সঙ্গে কথাবার্তা চালাচ্ছেন চোস্ত ইংরেজি অথবা হিন্দিতে।

Advertisement

আসানসোল পুরসভা তাদের দায়বোধ সুচারু ভাবে পালন করল। এখন আমাদের সচেতন হওয়ার সময়। সচেতন হওয়ার প্রয়োজন আছে। কারণ, পশ্চিমবঙ্গের এই সীমান্ত অঞ্চলে বাংলা ভাষার নড়বড়ে অবস্থান বুঝিয়ে দিতে চাইছে যে পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষা হিসেবে ক্রমেই অপ্রধান ভাষায় পরিণত হওয়ার দিকে পা বাড়াচ্ছে।

সারা পৃথিবীতে এখন সাত হাজারের কিছু বেশি ভাষা আছে। ভাবলে অবাক হতে হয়, এর শতকরা পঞ্চাশ ভাগই এমন অপ্রধান ভাষা। যাতে কথা বলেন, মাত্র হাজার দশেক মানুষ। বেশির ভাগ মানুষই কথা বলেন প্রধান বা শক্তিশালী ভাষায়।

বাংলা নিঃসন্দেহে এক ঐশ্বর্যশালী ভাষা। কিন্তু বাস্তব এটাই যে শক্তিশালী ভাষা হওয়ার জন্য জরুরি নয় ভাষাটি কতটা ঐতিহ্যময়, জরুরি নয় ভাষাটি নান্দনিক ঐশ্বর্যে কতখানি ঋদ্ধ। সেটিই শক্তিশালী ভাষা যে ভাষা অর্থনৈতিক আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে জরুরি, যে ভাষা বহন করে বাণিজ্য শক্তি, যে ভাষা রুজি জোগানে পারঙ্গম। সেখানে এগিয়ে নেই বাংলা।

শক্তিশালী বা প্রধান ভাষা যে পথে গ্রাস করে অপ্রধান ভাষাকে, তার নাম ‘ল্যাঙ্গুয়েজ শিফট’ বা ভাষার বাসাবদল। তা ঘটে প্রধান ভাষার প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ চাপে। রুজির প্রয়োজনে অথবা ‘চলতি হাওয়ার পন্থী’ থেকে নিজেকে আলাদা করে রাখতে না পারার অপারগতায়। প্রথমে কিছু মানুষ, ক্রমে ক্রমে পরের পুরো প্রজন্মই মাতৃভাষার বদলে গ্রহণ করে শক্তিশালী ভাষাকে। ভাষার বাসাবদল আসলে যেমন শক্তিশালী ভাষার আধিপত্য ও আগ্রাসনের গল্প, তেমনই অপ্রধান ভাষার ‘মৃত্যু’র মর্মন্তুদ গল্প। ভাষার মৃত্যু কিন্তু কোনও বিরল ঘটনা নয়। ভাষাবিদ ডেভিড ক্রিস্টালের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সারা পৃথিবীতে প্রতি দু’সপ্তাহে একটি করে ভাষার মৃত্যু হচ্ছে।

অনেকে ভাবতে পারেন পৃথিবীতে ভাষার সংখ্যা কমে গেলেই তো ভাল। তাতে বিশ্ব জুড়ে ভাষাগত যোগাযোগ প্রশস্ত হয়। এটি একদমই সুস্থ চিন্তা নয়। এ রকম চিন্তায় লগ্ন থাকে এক মাত্র পণ্যসংস্কৃতির সঙ্গে। কারণ, ভাষা, সংস্কৃতি সব একই রকম হলে, সব একই ছাঁচে ঢালাই হলেই পণ্যায়নের সুবিধা। বিশ্বায়নের হাত ধরে সে অনায়াসে তার আগ্রাসনের বিজয় পতাকা ওড়াতে পারে। আসলে একটি ভাষা নিছকই কিছু উচ্চারণ নয়, তা এক প্রাণময়তা। ভাষাবিদ ক্লদ অজেজের মতে তা এক ‘লিভিং ব্রিদিং অরগ্যানিজম’। একটি ভাষার সঙ্গে সংম্পৃক্ত থাকে একটি জাতির ইতিহাস, তার সংস্কৃতি, তার রুচি, তার শৈলি, তার নিজস্ব প্রকাশভঙ্গিমা, তার সৃজন শক্তি। জীববৈচিত্রের মতো পৃথিবী সুন্দর ভাষা বৈচিত্র্যেও। তাই একটি ভাষার মৃত্যু মানে একটি সৌন্দর্যের, একটি নান্দনিকতার মৃত্যু।

বাংলা ভাষার হয়তো মৃত্যু হবে না। কারণ, আমাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশে আমাদের গর্বের ভাষা পরম যত্নে লালিত হচ্ছে। কিন্তু বাংলাভাষাকে উজ্জীবিত করে রাখার কৃতিত্ব যদি শুধু বাংলাদেশেরই থাকে, তা আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের পক্ষে নিশ্চয়ই একেবারেই গৌরবের বিষয় নয়।

আসানসোল পুরসভার ইতিবাচক সিদ্ধান্তের পরে এই সীমান্ত বাংলায় বাংলা ভাষাকে গতিময়তা ও প্রাণময়তায় দীপ্ত রাখার জন্য আমাদের শুধরে নিতে হবে আমাদের ভুলভ্রান্তি। মনে মনে কিছু শপথ নিতে হবে। অপ্রয়োজনে বাংলা ছাড়া অন্য ভাষা নাই বা বললাম।

এটি বাস্তব, বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ের প্রতি আকর্ষণ কমে যাচ্ছে। অনেকের অভিযোগ, অধিকাংশ বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ের ঢিলেঢালা শিথিল ভাবের দিকে। সরকারি আনুকূল্যে এগুলিতে ‘কর্পোরেট’-এর মতো বাঁধন আনা যায় না, ‘স্পোকেন ইংলিশ’ শিক্ষার বিশেষ ব্যবস্থা-সহ।

ভাষা বেঁচে থাকে পরের প্রজন্মের মধ্যে তার বহমানতার সূত্র ধরে। সময়ের দাবিতে, জীবিকার তাগিদে আমাদের পরের প্রজন্মকে হয়তো অন্য ভাষার বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে হয়, তার মধ্যে অন্যায় কিছু নেই। কিন্তু দ্বিতীয় ভাষা থাকুক বাংলা। উপযুক্ত সম্মানের সঙ্গে তা শিখুক আমাদের সন্তানেরা। বাড়িতে থাকুক শিশুসাহিত্য, কিশোরসাহিত্য ও পত্রিকা। বাংলা ভাষার ঐশ্বর্যময় শিশু ও কিশোর সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় ঘটুক তাদের। ‘হাট্টিমা টিম টিম’-এর মতো ননসেন্স ছড়া, ‘আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম’-এর মতো গতিময় ছড়া, ঠাকুরমার ঝুলির মতো রূপকথার গল্প ইত্যাদির হাত ধরে নির্মাণ হোক তাদের কল্পজগত। তার পরে তারা স্বাদ নিতে পারবে রবিঠাকুরের অনির্বচনীয় রচনার বৈচিত্র্যে এবং আরও অনেক কিছুর।

বাংলা ভাষাকে তার মর্যাদা রক্ষার জন্য বারে বারেই সংগ্রাম করে যেতে হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী, বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠার জন্য তিন তিনটি ভাষা আন্দোলন হয়েছে— একুশে ফেব্রুয়ারি, মানভূম ও বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন।

শিল্পাঞ্চলে বাংলা ভাষার কোণঠাসা অবস্থানের মধ্যেও এই ইতিহাসকে বুকের মধ্যে রেখে হেঁটে চলেছেন এখানের মাতৃভাষাপ্রেমী মানুষেরা। আসানসোল শিল্পাঞ্চলের বেশ কিছু সাহিত্য-সংস্কৃতি সংগঠন, লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠী, নাট্য সংগঠন ইত্যাদি সংগ্রাম করে যাচ্ছেন এই অঞ্চলে বাংলা ভাষাকে, বাংলা সংস্কৃতিকে সজীব করে রাখার জন্য। পুরসভার এই সিদ্ধান্তে তাদের সংগ্রাম স্বীকৃতি পেল। তবে এখনও অনেক পথ চলা বাকি...

আসানসোলের চিকিৎসক ও সাহিত্যকর্মী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন