Basu Chatterjee

মগজের পুষ্টি, হৃদয়ের নরম আঁচ

তাঁর কাজের সমুদ্রের দিকে তাকালে সব সংশয়ই বিলীন হয়ে যায়।

Advertisement

চিরশ্রী মজুমদার

শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০২০ ০০:৪১
Share:

বাসু চট্টোপাধ্যায়, যিনি প্রথমে চিত্রকর ও পরে চিত্রকার, তাঁর জীবন সম্মানিত, অনুসৃত ও পরিপূর্ণ বলাই যায়। কিন্তু এই প্রবাসী বঙ্গসন্তানের জীবনের বৃহত্তম ট্র্যাজেডি কী? প্রচারবিমুখ দীর্ঘায়ত জীবন, সেই জীবনে কেরিয়ারের ফিনিশিং স্পটে দাঁড়িয়ে কিছু প্রশ্নযোগ্য সিনেমা তৈরি, না কি হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের ছবির সঙ্গে তাঁর ঘরানার প্রতিনিয়ত সম্পৃক্তকরণ?

Advertisement

তাঁর কাজের সমুদ্রের দিকে তাকালে সব সংশয়ই বিলীন হয়ে যায়। পড়ে থাকে শুধু ভারতীয় পর্দার বিশিষ্ট কিছু প্রকরণ, যার নির্মাণে তাঁর অগাধ অবদান। অজমেঢ়ের এই মেধাবী তরুণের সঙ্গে বিশ্বসাহিত্যের পরিচয় পাকা হয়েছিল লাইব্রেরিয়ান-চাকরির দিনগুলোয়। অব্যবহিত পরেই ‘ফিল্ম সোসাইটি’-তে বিশ্বচলচ্চিত্র চর্চাকালেই গল্প বোনার নিজস্ব কায়দা রপ্ত করেন। প্রথম পরিচালনায় নবীন সাহিত্যিক রাজেন্দ্র যাদবের ‘নয়ি কহানি’ গোত্রের উপন্যাসের খণ্ড চিত্রায়িত করেন। সমসাময়িক চলচ্চিত্রের নিরিখে সে ছবির দৈর্ঘ্য বেশ কম, গঠনও আলাদা। বিষয় গতে বাঁধা রংচঙে নয়। রাজনীতির শেওলা ধরা, হৃদয় মোচড়ানো। জ়ুম করে মুহূর্তে স্থির থাকে ক্যামেরা। মণি কলের ‘উসকি রোটি’, মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোম’-এর পাশাপাশি তাঁর ‘সারা আকাশ’ ১৯৬৯-এ যে ‘নিউ ওয়েভ সিনেমা’-র সূচনা করেছিল, আশির দশকে তা-ই তো ভারতীয় সমান্তরাল সিনেমা নামে দুনিয়া শাসন করেছে।

কয়েক ছবি পরই আরব সাগরপারের বঙ্গীয়-ত্রিশক্তির অংশ হয়ে ওঠেন বাসু। হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় এবং বাসু ভট্টাচার্যের সঙ্গে তাঁর চিত্র-ব্যাকরণ ‘মিডল অব দ্য রোড সিনেমা’-র অভিধা পায়। যেখানে পাশ্চাত্য ঢঙের পপ-হিপি সংস্কৃতির দাপট, লার্জার দ্যান লাইফ চরিত্র, কুমির পোষা খলনায়ক নেই। আছে পাশের বাড়ির যুবক-যুবতী, মধ্যবিত্ত জীবনের হাসি-ঠাট্টা কাব্যময়তা। সমনামী হওয়ার জন্য দুই বাসুকে এক ভাবা তো আছেই, দুঃখ বেশি হয় যখন ছবির ছন্দ মিলছে দেখে ভারতীয় দর্শক তাঁকেও হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় বলেই ডাকেন। দু’জনের ছবিতেই উৎপল দত্ত গোলমেলে কর্তামশাই, অমোল পালেকর আটপৌরে নায়ক। দু’জনেই ধর্মেন্দ্রকে মারপিটের বদলে চশমা পরিয়ে ছাত্র পড়াতে পাঠান, অমিতাভকে হারমোনিয়াম নিয়ে বসিয়ে দেন।

Advertisement

বাসুকে আলাদা করা যায় নারী চরিত্রের আঁচড়ে। তাঁর নায়িকা সময়ের বাঁক মেনে চাকুরিরতা, স্বাধীনচেতা। যাঁর জীবনে প্রাক্তন আছে, দু’জন অনুরাগীকেই সমান প্রশ্রয় দেন (‘রজনীগন্ধা’, ‘ছোটি সি বাত’-এর বিদ্যা সিংহ, ‘স্বামী’-র শাবানা)। পরিবারের উপার্জক (‘দিল্লগি’-র হেমা), চাহিদাসম্পন্ন স্ত্রী (‘প্রিয়তমা’-র নীতু), ছক উল্টে প্রেমিককে দামি রেস্তরাঁয় নিয়ে গিয়ে বিল মেটানো কিশোরী (‘চামেলি কি শাদি’)। দূরদর্শনে সমাজের বিষদাঁত ভাঙা ‘রজনী’। সাহিত্যের চিত্রনাট্য-সম্ভাবনা পর্যবেক্ষণেও বাসু অভ্রান্ত, লেখকের প্রতি আন্তরিক বিশ্বস্ত। প্রমাণ ‘চিতচোর’ থেকে ‘ব্যোমকেশ বক্সী’।

তাঁর ছবিধারার অমূল্য সম্পদ শহরের চরিত্র হয়ে ওঠা। ‘ছোটি সি বাত’-এ মানুষগুলি বেশি সুন্দর, না কি মায়ানগরী? ছবিটিতে বম্বের ‘বেস্ট’ বাস পরিষেবা, ‘জ্যাকসন তোলারাম’ কোম্পানিতে চাকরি করার তৃপ্তি, ‘ফ্লোরা’-র চাইনিজ়, ‘সমোবর’-এর ‘চিকেন আ-লা-পুস’ শহরটার সংজ্ঞায় পরিণত হয়েছিল। ‘বাতোঁ বাতোঁ মেঁ’-র কেন্দ্রবিন্দু লোকাল ট্রেনের কামরা, ‘খট্টা মিঠা’-য় দেখিয়েছেন শহরতলিতে পার্সিদের জীবনযাত্রা। তবু তাঁর তুলিতে বম্বের শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য সম্ভবত ধরা পড়েছে ‘মঞ্জিল’-এর ‘রিমঝিম গিরে শাওন/ সুলগ সুলগ যায়ে মন’-এর চার মিনিটে। মেরিন ড্রাইভ, স্টেশন-স্টেডিয়ামের স্থাপত্য, চার্চগেট-এর জলীয় কোলাজে বাসু ও তাঁর ক্যামেরা-সহযোগী কে কে মহাজন নিখাদ রোম্যান্সকে পর্দাবন্দি করেছেন। পঞ্চমী সুর ও লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠের জাদুতে সাগরনগরীর রূপ যেন গলে গলে পড়ছে!

সে সময়ের ফর্মুলা-ছবির উল্টো দিকে বাসুর এই অল্টার-বিশ্বে কৌতুক আর স্বপ্নের সঙ্গেই আছে প্রখর সমাজচেতনা। এই দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যে ভর করেই আশির দশকে আরও এক ‘ট্রিনিটি’ রচিত হয়েছিল বাসু, শ্যাম বেনেগাল ও সাই পরাঞ্জপে-র সিনেমা-দর্শনে। বাসু-র প্রিয় ‘চউল’ সিনেমায় ঘোষিত ভাবে অনুপ্রাণিত ছিল পরাঞ্জপে-র ‘কথা’। বেনেগাল-বৃত্তের শক্তিশালী অভিনেতাদের নিয়ে বাসু তৈরি করেছিলেন ‘কমলা কি মৌত’, ‘কাকাজি কহিঁ’।

নায়ক ও ভিলেন চরিত্রে তফাত রাখতেন না বাসু। তাই ‘শউকিন’-এ যে প্লট হাস্যরসাত্মক, প্রজন্ম প্রেক্ষাপট ও অনুষঙ্গের বদলে ‘গুদগুদি’-তে তাকেই বিকৃতি মনে হলে পরিচালকের দোষ ধরবেন না। মনে রাখতে হবে, এই বাঙালিকে পাঠ্য করে আজ অনেকখানি বিবর্তিত ভারতীয় চলচ্চিত্র। ‘বাসুদা’-র সিনেমা’ বার বার পুনর্নির্মাণের লোভ সংবরণ করতেই পারেন না তাবড় প্রযোজনাগুলি। মণিরত্নম থেকে সুজিত সরকারের ভাবনা সিঞ্চিত করেছেন, এই নশ্বরবিনাশের পরও বাসু চট্টোপাধ্যায় নিশ্চিত মার্গ নির্দেশ করবেন এ দেশি সিনেমার।

সে সব সিনেমায় পুরস্কার জনপ্রিয়তা মিলবে, ভারত-চলচ্চিত্র বিকশিত হবে, সমৃদ্ধও হবে। কিন্তু খেদ একটাই— সে ট্র্যাজেডি ভারতীয় দর্শকের, বাসু চট্টোপাধ্যায়ের নয়। তা হল এমন সিনেমা হয় মগজের পুষ্টি জোগাবে, নয়তো এসকেপিজ়ম-ধর্মিতায় মনের অপ্রাপ্তি ঢাকবে। কিন্তু, বাসুদা-র মতো অনুভবে হৃদয় ভিজিয়ে নরম আঁচে মন গলাবে কি? যাকে পরিচালকের আর এক সহযোগী, সদ্য প্রয়াত কবি যোগেশ বলতেন, সুলগ সুলগ?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন