‘ফ্যাশন’ নয়, সঙ্কট

অবসাদে আক্রান্ত রোগীকে সুস্থ করিবার উদ্দেশ্যে সরকারের দাওয়াই হইল সদর্থক চিন্তা, পর্যাপ্ত ঘুম। চিকিৎসকের সহায়তার উল্লেখও নাই তাহাতে। দরিদ্র টেনিদার দারিদ্র লইয়া আক্ষেপ দেখিয়া প্যালারাম তাহাকে বড়লোক হইবার নিদান দিয়াছিল

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

বিশ্বে যত আত্মহনন ঘটিয়া থাকে, তাহার এক-তৃতীয়াংশ ভারই গ্রহণ করে ভারত। কেহ বলিতে পারেন, জনসংখ্যার কারণেই আত্মহত্যার সংখ্যাও বেশি হইবে। কিন্তু, হিসাব বলিতেছে, দুনিয়ায় প্রতি এক লক্ষ মানুষের মধ্যে গড়ে যত জন আত্মহত্যা করেন, ভারতে সেই সংখ্যাটি কার্যত দ্বিগুণ। কেন এমন আত্মঘাতী প্রবণতা, তাহা স্পষ্ট নহে। বস্তুত, স্পষ্ট করিবার প্রক্রিয়াটিই উপস্থিত নহে। কোনও আত্মহত্যার ঘটনাই তীব্র মানসিক সমস্যা ব্যতীত নহে। কোনও ক্ষেত্রে তাহা দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা, কোথাও আবার সাময়িক অস্থিরতা। সমস্যা হইল, মানসিক অসুস্থতাও যে ‘রোগ’, পরিহাসের বিষয় নহে, এই বোধটিই ভারতে গড়িয়া উঠে নাই। মানসিক অসুস্থতাকে ‘পাগলামি’ বলিয়া কৌতুক করাই জনমানসের প্রবণতা। জনগণের ভ্রম সংশোধনের দায়িত্ব লইতে পারিত সরকার। সে কাজ তাহারা করে নাই। বরং, এমন পদক্ষেপ করিয়াছে, যাহাতে অনুমান হয়, সমস্যাটি সম্বন্ধে সরকারও সচেতন নহে। অবসাদে আক্রান্ত রোগীকে সুস্থ করিবার উদ্দেশ্যে সরকারের দাওয়াই হইল সদর্থক চিন্তা, পর্যাপ্ত ঘুম। চিকিৎসকের সহায়তার উল্লেখও নাই তাহাতে। দরিদ্র টেনিদার দারিদ্র লইয়া আক্ষেপ দেখিয়া প্যালারাম তাহাকে বড়লোক হইবার নিদান দিয়াছিল। দুর্জনে বলিবে, সরকারের বিজ্ঞপ্তিও তদ্রূপ। চিকিৎসকের অনুল্লেখ হইতে অবসাদকে অসুখ বলিয়া গণ্য করিতে সরকারের অনীহা স্পষ্ট। স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করিয়াছিলেন, দশ কোটি পরিবারকে চিকিৎসার জন্য পাঁচ লক্ষের অর্থসাহায্য করা হইবে। শারীরিক সঙ্কটের কালে সাহায্য পাইয়াছেন চালকলের মজুর। কিন্তু মানসিক অবসাদ? লালকেল্লা বহু দূর।

Advertisement

সমীক্ষা জানাইয়াছে, নারীদের আত্মহননের মাত্রা অধিক। বিশ্বের হিসাবে পুরুষদের শতাংশের হিসাবটি ২৪, নারীদের ৩৭। যেখানে অবসাদ বিষয়টিই স্বল্পালোচিত, সেখানে নারীদের ক্ষেত্রে অজ্ঞানতার অন্ধকার গাঢ়তর হওয়া স্বাভাবিক। ফলত, প্রশ্নটিও জটিলতর হইয়া উঠে। অথচ দৈনন্দিন জীবন বিশ্লেষণ করিলেই উত্তর মিলিবার আশা ছিল। নিজেকে অপাঙ্‌ক্তেয় বোধ করা, সাংসারিক সঙ্কট, পারিবারিক নিপীড়ন, পুরুষের মদ্যপানজনিত অত্যাচার— আত্মহননের পশ্চাতে যেই কারণগুলি প্রতীয়মান হয়, তাহা একান্তই নারীসমাজের সঙ্কট। সংসারের সঙ্কটের পূর্ণাঙ্গ দায়ভার গ্রহণ করিতে হইবে কোনও না কোনও অর্ধাঙ্গিনীকে— অনভিপ্রেত হইলেও ইহাই দুনিয়ার নিয়ম। সমাজবিজ্ঞানের এক গবেষণার তথ্য জানাইতেছে, লিঙ্গবৈষম্যের কারণে অল্প বয়সে অপুষ্টির বিপদ নারীদের ক্ষেত্রেই অধিক। বয়স বাড়িলে ইহার ফল ভোগ করিতে হয়— অধিক রোগের শিকার নারীরাই। স্মরণে আসিতে পারে ‘স্ত্রীর পত্র’। সংসারের নিকট অপমানিত হইয়া যখন কাপড়ে আগুন দিয়া আত্মহননের পথ বাছিয়া লইয়াছিল বিন্দু, পুরুষগণ উহাকে ‘ফ্যাশন’ বলিয়াছিল। অনুমান করা চলে, পুরুষতন্ত্র সেই অবস্থান হইতে বিশেষ নড়ে নাই। ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক’রা কেন অধিকতর আত্মহত্যাপ্রবণ, তাহা নিতান্তই তাঁহাদের বিলাস না কি গূঢ়তর কোনও সামাজিক সমস্যার দ্যোতক, এই প্রশ্নগুলি রাষ্ট্র করিবে না। সমস্যাটিকে যদি আমূল বুঝিতে হয়, তবে একই সঙ্গে দুইটি সঙ্কট চিনিয়া লওয়া প্রয়োজন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন