মহাতারকা নিয়ে আদিখ্যেতা

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ভারতীয় ক্রিকেটে সর্বকালের সেরা অধিনায়কদের এক জন। সুতরাং, সিএবি-র সভাপতি হওয়া সত্ত্বেও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে হালফিলের খেলোয়াড়দের ভালমন্দ নিয়ে লিখে তিনি পার পেয়ে যান।

Advertisement

সুরবেক বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০১৭ ১৩:০৫
Share:

ভারতীয় ক্রিকেট ব্যবস্থার উদ্দেশে ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহের নিক্ষিপ্ত পত্রবোমায় সবচেয়ে মারাত্মক বিস্ফোরক উপাদানটির নাম ‘সুপারস্টার সিনড্রোম’। মহাতারকাদের নিয়ে আদিখ্যেতার রোগ। যে রোগে ভুগলে মহাতারকাদের কোনও দোষকেই দোষ বলে শনাক্ত করা যায় না। এই রোগে আক্রান্তেরা মনে করেন, মহাতারকাদের ক্ষেত্রে নিয়মনীতি খাটে না, যা খাটে আম আদমির বেলায়।

Advertisement

সুনীল গাওস্কর ভারতীয় ব্যাটিং-শৌর্যের প্রতীক। অতএব, খেলোয়াড়দের এজেন্টের কাজ করে যে সংস্থা, তিনি তার কর্ণধার হয়েও অবলীলায় ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের বেতনভুক ধারাভাষ্যকার হিসেবে ম্যাচের সময়ে ভারতীয় ক্রিকেটারদের সম্পর্কে মন্তব্য করতে পারেন, কোনও সমস্যা হয় না। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ভারতীয় ক্রিকেটে সর্বকালের সেরা অধিনায়কদের এক জন। সুতরাং, সিএবি-র সভাপতি হওয়া সত্ত্বেও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে হালফিলের খেলোয়াড়দের ভালমন্দ নিয়ে লিখে তিনি পার পেয়ে যান। রাহুল দ্রাবিড়ের মতো কেতাদুরস্ত, নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যানই বা ভারতীয় ক্রিকেটে এসেছেন ক’জন? কাজেই, জাতীয় দলের কোচ হিসেবে তাঁর সঙ্গে বোর্ড এক বছরের বদলে দশ মাসের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়, যাতে রাহুল বছরের বাকি দু’টো মাস আইপিএলে কোচ বা মেন্টর হতে পারেন অনায়াসে। আর মহেন্দ্র সিংহ ধোনি তো ভারতকে দু’দুটো বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন। তাই, তিনি টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেও কেবল ওয়ান ডে আর টি-টোয়েন্টি খেলার জন্য বোর্ড তাঁর সঙ্গে সর্বোচ্চ মানের ‘এ’ চুক্তি করবে, তাতে অসুবিধে কোথায়!

রামচন্দ্র গুহ বলছেন, মহাতারকাদের নিয়ে এই আদিখ্যেতার অবসান না হলে বিচারপতি লোঢা কমিটি প্রস্তাবিত সংস্কার ভারতীয় ক্রিকেটে কার্যকর করা প্রায় অসম্ভব। এই ইতিহাসবিদ একটি নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেট ব্যবস্থায় মহাতারকা-পুজোর রীতিকে। দরকারি কাজ করেছেন তিনি। তবে, শুধু ক্রিকেট না, আমাদের গোটা আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা এই রোগে আক্রান্ত। প্রশাসনিক বি‌ভিন্ন সিদ্ধান্তে, মানুষের নানাবিধ আচরণে, প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপে রোগের সমস্ত লক্ষণ প্রকট। এই মুহূর্তে ক্রিকেট ভারতের সব চেয়ে জনপ্রিয় খেলা, অন্য সব খেলার চেয়ে অনেক বেশি রোজগার করে। কাজেই, গোটা দেশের যা রোগ, তা ক্রিকেটকে ধরবেই।

Advertisement

ইন্দিরা গাঁধী তাঁর সময়ে কংগ্রেস দলে এক ব্যক্তি এক পদের নিয়ম চালু করেছিলেন। কিন্তু তিনি একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভানেত্রী, দু’টি পদেই থেকে গেলেন। অবশ্য তাঁর উপর কি ওই নিয়ম খাটতে পারে? ইন্দিরার পরে তাঁর পুত্র রাজীব, তাঁর পরে নরসিংহ রাওয়ের সময়েও দলে একই নিয়ম বলবৎ ছিল। আর ওই দু’জনও নিয়মের ঊর্ধ্বে থেকে যান।

সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ভয়ে নয়, বরং গদগদ ভক্তিতে মেনে নেয় নিয়মের এই যুক্তিহীন ব্যতিক্রমকে। আর সমাজে মহাতারকার এই নিরন্তর ভজনা আখেরে অনেক সময়ে জন্ম দেয় বৈষম্যমূলক আচরণের। আইন সবার ক্ষেত্রে সমান ভাবে প্রযোজ্য না হওয়াই তো অন্যায়। দুর্ঘটনায় মৃত গায়কের গাড়ির চালককে ৬৪ দিন জেলে থাকতে হয়। কিন্তু টিভি সিরিয়ালের জনপ্রিয় অভিনেতাকে গ্রেফতার করতে ‘ধীরে চলো’ নীতি নেয় সেই একই রাজ্যের পুলিশ। যেন তাঁর খাতির পাওয়ার বিশেষ অধিকার রয়েছে। যেমনটা দেখেছিলাম সলমন খানের বেলায়। এই মহাতারকা-পুজোর রোগ দেখিয়ে দেয়, আমাদের সামাজিক আত্মায় এখনও প্রোথিত আছে এক সামন্ততান্ত্রিক ধারণা, যা কিছুতেই ঝেড়ে ফেলা যাচ্ছে না।

অথচ বিশ্বসেরা গল্ফ খেলোয়াড় টাইগার উড‌্সকে বেপরোয়া গাড়ি চালাতে দেখেই মার্কিন মুলুকের ফ্লোরিডা পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। এবং মহাতারকা উড‌্সকে কোনও বিশেষ খাতির করে না, তিনি নেশাগ্রস্ত কি না সেটা পরীক্ষা করা হয় সমস্ত নিয়ম ঠিক ঠিক অনুসরণ করে। মার্কিন মুলুকেরই আর এক মহাতারকা অ্যাথলিট কার্ল লিউইসের বেলাতেও কোনও ব্যতিক্রম হয়নি। ১৯৮৪-র লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকসে একাধিক সোনা জেতা লিউইস বিয়ার পান করে বেপরোয়া গাড়ি চালাচ্ছিলেন বলে পুলিশ তাঁকে রেয়াত করেনি, যথাবিধি গ্রেফতার করেছিল।

আর একটি দৃষ্টান্ত। এক বার ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার সকাল সকাল জরুরি বৈঠক ডেকেছেন। থ্যাচার সে দিন কোনও কারণে প্রাতরাশ করার সময় পাননি। খিদেতে পেট চুঁইচুঁই করছে। বৈঠকের মাঝখানে সবার কাছে পাঁচ-সাত মিনিটের জন্য মাফ চেয়ে উঠে থ্যাচার নিজে উঠে খাবার তৈরি করে কোনও রকমেখেয়ে ফের আলোচনায় বসেছিলেন। আমরা ভাবতে পারব! না পারার কারণ সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আনুগত্য।

আর ঠিক এই জায়গাটাতেই আঘাত করেছেন রামচন্দ্র গুহ। তাতে জগদ্দল পাথরটা হয়তো সরবে না। তবু এ দেশেরই কোনও এক জন পাথরটা একটু নড়িয়ে দিলেন, সেটাই বা কম কী!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন