দুর্ভাগা সেই দেশ, যেখানে স্বাভাবিক প্রশাসনিকতাও আদালতের আদেশের অপেক্ষায় থাকে। দুর্ভাগ্য, ভারত আজ সেই অবস্থাতেই পৌঁছাইয়াছে। গোরক্ষা-হিংসা বন্ধ করিতে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিল, দেশের প্রতিটি জেলায় ডিএসপি পদমর্যাদার কোনও পুলিশ অফিসারের দায়িত্বে দল গঠন করিতে হইবে। গোহত্যা বন্ধের নামে যাহাতে কেহ হিংসাত্মক আচরণ না করিতে পারে, তাহা নিশ্চিত করাই এই দলের কাজ। হাইওয়েগুলিও যাহাতে নিরাপদ হয়, তাহাও নিশ্চিত করিতে হইবে। আদালতকে এহেন নির্দেশ দিতে হইতেছে, তাহা অসীম লজ্জার। কাহারও মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হইলে তাহা রক্ষা করা প্রশাসনের স্বাভাবিক দায়িত্ব। গোরক্ষক হউক বা অন্য কোনও দুষ্কৃতী, সামাজিক পরিসরে পুলিশ-প্রশাসন তাহাদের নিয়ন্ত্রণে রাখিবে, তাহাদের হাত হইতে সাধারণ মানুষকে বাঁচাইবে, ইহা প্রশাসনের প্রাথমিক কর্তব্য। সুপ্রিম কোর্টকে এই কর্তব্য পালন করিবার আদেশ দিতে হইতেছে, সেই সত্যটি গো-রক্ষা তাণ্ডবের বাড়াবাড়ি অপেক্ষা নেহাত কম উদ্বেগের নহে। প্রশাসন কেন নিজের দায়িত্ব বিস্মৃত হয়, এই প্রশ্নের উত্তর ভারত বিলক্ষণ জানে। রাজনৈতিক শাসকদের কর্মসূচিকেই প্রশাসন নিজের কর্মসূচি বলিয়া ধরিয়া লয়। তাহার কারণ বহুবিধ। কোথাও প্রসাদের আকাঙ্ক্ষা, কোথাও নিছক ভাবিবার অনভ্যাস, কোথাও হয়তো নেতাদের রোষানল হইতে বাঁচিবার চেষ্টা। কিন্তু, তাহার ফল হইল, গো-রক্ষা সন্ত্রাসের ন্যায় চরম বে-আইনি কাজের বিরুদ্ধেও প্রশাসন সক্রিয় হইতে পারে না। তাহাকে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের অপেক্ষায় থাকিতে হয়। অবশ্য প্রশ্ন, নির্দেশের পরও কি প্রশাসন দায়িত্ব ফিরিবে?
রাজধর্ম হইতে বিচ্যুত হওয়ার বৃহত্তম বিপদ এখানেই। প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্তা যদি দলের নেতা হইয়াই থাকেন— অথবা কোনও একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর— কিন্তু, গোটা দেশের নেতা না হইতে পারেন, তবে তাঁহার প্রশাসনও পক্ষপাতহীনতা হারায়। অপরাধের রংবিচার করিতে থাকে, ক্ষেত্রবিশেষে অন্ধ হইয়া যায়। নির্দ্বিধায় বলা চলে, প্রশাসন যদি নিরপেক্ষ হইত, তবে রাজনৈতিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দেশের মুসলমান নাগরিকরা অনেক বেশি নিরাপদ বোধ করিতে পারিতেন। মাথায় গেরুয়া ফেট্টি বাঁধিয়া যাহারা গো-রক্ষার নামে সন্ত্রাস করিয়া বেড়াইতেছে, তাহারা পুলিশকে ভয় পাইত। সেই ভয়ই তাহাদের সংযত করিত। কিন্তু, তাহার জন্য প্রশাসনকে জানিতে হইত যে দিল্লির ক্ষমতার দরবারে এই উগ্রতার, এই হিংস্রতার প্রতি সমর্থন নাই। নরেন্দ্র মোদী ২০০২ সালে যে বার্তাটি দিতে ব্যর্থ হইয়াছিলেন, ২০১৭ সালেও তিনি সেই বার্তাটি দিয়া উঠিতে পারিলেন না। রাজধর্ম সম্ভবত তাঁহার ধর্ম নহে।
সুপ্রিম কোর্টের আদেশ বলিতেছে, নরেন্দ্র মোদীর মুখের কথায় ভরসা করা চলে না। এই আদেশটিকে এই ভাবেও পাঠ করা সম্ভব যে ভরসা করিবার কোনও কারণ প্রধানমন্ত্রী গত তিন বৎসরের অধিক সময়ে তৈরি করিতে পারেন নাই। তিনি মুখে যাহাই বলুন, তাঁহার কোনও আচরণে আজ অবধি প্রমাণ মিলে নাই যে তিনি এই গৈরিক সন্ত্রাসের বিরোধী। প্রশাসন তাঁহার মুখের কথায় আমল দেয় নাই, তাঁহার আচরণের মাপকাঠিতে জল মাপিয়াছে। যিনি রাজধর্ম পালনে ক্রমাগত ব্যর্থ হইতেছেন, বস্তুত সফল হওয়ার চেষ্টাই করিতেছেন না, তাঁহার মৌখিক সদিচ্ছাকে কতখানি গুরুত্ব দেওয়া বিধেয়, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ কি তাহা দেখাইয়া দিল না? গোরক্ষকদের নিয়ন্ত্রণ করিতে না পারা একটি উপসর্গমাত্র। মূল রোগ রাজধর্ম পালনে অনীহা। মূল রোগ ভারত নামক ভৌগোলিক পরিসরটিকে তাহার যাবতীয় বৈপরীত্য সমেত একটি দেশ হিসাবে দেখিতে পারিবার অক্ষমতা। তাহার কি চিকিৎসা সম্ভব?