হরেক দফতরে ছড়াইয়া থাকা অব্যবহৃত বরাদ্দ একত্র করিয়া সেই টাকায় পরিকাঠামো গড়া হইবে, সিদ্ধান্ত করিয়াছে রাজ্য সরকার। পরিকাঠামোর গুরুত্ব প্রশ্নাতীত। কিন্তু, পরিকাঠামো তৈয়ারি হইলেই বিনিয়োগ আসিবে, এহেন সরলরৈখিক বিশ্বাসটি বিপজ্জনক। যথাযথ পরিকাঠামো বিনিয়োগের জরুরি শর্ত, যথেষ্ট শর্ত নহে। অর্থাৎ, শুধু পরিকাঠামো থাকিলেই হইবে না, আরও কিছু প্রয়োজন। সেই ‘আরও কিছু’টি কী? অনুমান করা চলে, প্রশ্নটির উত্তর মুখ্যমন্ত্রী জানেন। বস্তুত, পরিকাঠামো নির্মাণের কাজটিকে ঠিক ভাবে করিতে হইলেও সেই ‘আরও কিছু’-র অপেক্ষায় তাঁহাকে থাকিতে হইবে। প্রথম প্রয়োজন, একটি সুস্পষ্ট জমি নীতি। বারো হাজার কোটি টাকা ব্যয় করিয়া পরিকাঠামো নির্মাণ করিতে হইলে শুধু সম্প্রসারণ আর পরিমার্জনেই থামিয়া থাকা যায় না। তাহার জন্য নূতন রাস্তা গড়িতে হয়, নূতন পরিসর নির্মাণ করিতে হয়। অর্থাৎ, প্রকৃত অর্থে পরিকাঠামো গড়িতে চাহিলেও জমি লাগিবে। তেমনই, সেই পরিকাঠামোর মাধ্যমে যদি সত্যই লগ্নি আকর্ষণ করিতে হয়, তবে সেই বিনিয়োগের জন্যও জমি চাই। বৃহৎ শিল্পের জন্য খুচরা নহে, এক লপ্তে বড় জমি প্রয়োজন।
দ্বিতীয় প্রয়োজন, শিল্পের পরিবেশ। আরও স্পষ্ট ভাবে বলিলে, রাজ্য জুড়িয়া সিন্ডিকেটের দাপট নিয়ন্ত্রণ। বেসরকারি পুঁজির স্বার্থে যেমন সিন্ডিকেটের দাপট নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন, পরিকাঠামো খাতে সরকারি লগ্নির ক্ষেত্রেও প্রয়োজনটি সমান। কারণ, সরকারি লগ্নিতেও বিবিধ ভাগবাঁটোয়ারার পর যাহা পড়িয়া থাকে, তাহাতে শিল্পাকর্ষক পরিকাঠামো নির্মাণ করা যাইবে না। সিন্ডিকেটের দাদাগিরি এই রাজ্যে বিনিয়োগের পথে একটি বিপুল বাধা। তাহার সমাধান না হইলে শুধু পরিকাঠামোর টানে শিল্প আসিবে না। রাজ্যের প্রশাসকদের বুঝিতে হইবে, পরিকাঠামোর উপর প্রতিটি রাজ্যই কমবেশি জোর দিতেছে। কাজেই, শুধু পশ্চিমবঙ্গেই উন্নত পরিকাঠামো মিলিবে, বাস্তব এই রকম নহে। পরিকাঠামোর অভাব থাকিলে বিনিয়োগ আসে না, তাহা ঠিক, কিন্তু শুধু সেই অভাবটি মিটাইলেই চলিবে না।
অতএব, প্রশ্নটি পুরাদস্তুর রাজনৈতিক। গত ছয় বৎসরে যে প্রশ্নের কোনও সুস্পষ্ট উত্তর মুখ্যমন্ত্রী দেন নাই, তিনি আবারও সেই প্রশ্নেরই সম্মুখীন— জমি অধিগ্রহণ না করিবার জেদ বিদায় হইবে কি? তাহা কি সিন্ডিকেটকেও সঙ্গে লইয়া যাইবে? এই দুইটি প্রশ্নের ইতিবাচক উত্তরের উপর রাজ্যের শিল্প-সম্ভাবনা নির্ভরশীল। দুইটি প্রশ্নই আবার ক্লায়েন্টেলিজম-এর রাজনীতির সহিত অঙ্গাঙ্গি জড়িত। জমির রাজনীতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মসনদে বসাইয়াছে। এই রাজ্যের পরিবর্তন-ভীত মানুষ কৃষির অনুৎপাদনশীল কিন্তু অতি পরিচিত জীবিকাকে ছাড়িয়া শিল্পের জন্য দরজা খুলিতে ইতস্তত করে। তাঁহারাই ভোটব্যাংক। উন্নয়নের স্বার্থে, রাজ্যের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থে কি এই মানুষগুলিকে সাময়িক অনিশ্চয়তার সম্মুখীন করিতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব সম্মত হইবে? সিন্ডিকেট যাহাদের দ্রুত আর্থিক সচ্ছলতা আনিয়া দিয়াছে, মানুষ অভিজ্ঞতায় জানেন, তাহারা শাসক দলের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মুখ্যমন্ত্রী কি তাহাদের চটাইতে ভরসা করিবেন? মূল প্রশ্ন এই দুইটিই। ইহার সদুত্তর না মিলিলে পরিকাঠামোয় বিনিয়োগের জরুরি সিদ্ধান্তটিও বহুলাংশে অর্থহীন হইয়া যাইবে।