সম্পাদকীয় ১

স্বতন্ত্র

ইতিহাসে ফিরিয়া দেখিতে হইবে— কোন মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধেই বা রাজনৈতিক নেতাগণ এত খড়্গহস্ত ছিলেন?

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share:

প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার টি এন শেষন।

প্রয়াত হইলেন প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার তিরুনেল্লাই নারায়ণ আইয়ার শেষন। এই সংবাদ কেবল এক কোণে পড়িয়া নাই, রীতিমতো আলোচ্য হইয়া উঠিয়াছে, ইহাই সংবাদটির বৃহত্তম তাৎপর্য। ১৯৫০ সালে সুকুমার সেন হইতে আজ অবধি তেইশ জন মুখ্য নির্বাচন কমিশনারকে পাইয়াছে ভারত। কাহাকে লইয়া এত আলোচনা হইয়াছে, বিশেষ করিয়া যেখানে তেইশ বৎসর হইল অবসর গ্রহণ করিয়াছেন সেই ব্যক্তি, এবং সম্পূর্ণ লোকচক্ষুর অন্তরালে বাস করিতেছিলেন? ইতিহাসে ফিরিয়া দেখিতে হইবে— কোন মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধেই বা রাজনৈতিক নেতাগণ এত খড়্গহস্ত ছিলেন? নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনিবার ফলে এক দিকে যেমন তাঁহাকে গণতান্ত্রিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার প্রতীকস্বরূপ দেখা হইয়াছে, অপর দিকে ‘শেষন বনাম নেশন’ বলিয়া কটাক্ষেরও অন্ত ছিল না। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু তাঁহাকে ‘পাগল’ বলিয়াছিলেন; নির্বাচনী প্রক্রিয়ার কড়াকড়িতে জনতাই বিপদে পড়িতেছে, বুঝাইবার চেষ্টাও হইয়াছিল। বিপ্রতীপে, ভোট দিবার ক্ষেত্রে সচিত্র পরিচয়পত্র চালু করা কিংবা ভোট চাহিবার ক্ষেত্রে টাকা ছড়াইবার দুর্নীতি রদ করিবার ব্যাপারে অনড় থাকিয়াছিলেন শেষন। তবে তিনি কী করিয়াছিলেন, সেই তথ্য অপেক্ষা জরুরি হইল, কোন ভাবনা তিনি রাখিয়া যাইলেন।

Advertisement

শেষনকে শেষ শ্রদ্ধা জানাইতে গিয়া কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গাঁধী উল্লেখ করিয়াছেন, এক সময় আমাদের নির্বাচন কমিশনারেরা সাহসী ও পক্ষপাতহীন ছিলেন, এবং সকলে তাঁহাদের ভয় পাইতেন। বস্তুত, ইহাই শেষনের উত্তরাধিকার। বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসক দলের বিরুদ্ধে বারংবার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করিবার অভিযোগ উঠিয়া থাকে। সিবিআই-এর এক কর্তার সহিত অপর কর্তার প্রকাশ্যে লড়াই হয়, বিরোধী নেতা মুখ খুলিলেই তাঁহার গৃহে সদাতৎপর ইডি পৌঁছাইয়া যায়, আবার কোনও ব্যক্তির ভাগ্যে জুটে আয়কর তল্লাশি বা শহুরে নকশাল বলিয়া পুলিশি জেরা, সেরা বিশ্ববিদ্যালয় বা রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের শীর্ষে বসিয়া পড়েন কেবল শাসক ঘনিষ্ঠেরা— সম্ভবত দেশের আর কোনও প্রতিষ্ঠানেরই এই আনুগত্যের করাল গ্রাস হইতে মুক্তি নাই। একের পর এক নির্বাচনে— লোকসভা বা বিধানসভা— নির্বাচন কমিশনের শাসক দলের প্রতি পক্ষপাতের অভিযোগ কম উঠে নাই। কখনও সমদোষে বিরোধী অপেক্ষা শাসকপক্ষকে লঘুদণ্ড দেওয়ার অভিযোগ, কখনও বোতাম টিপিলে কেবল পদ্ম চিহ্নে ভোট পড়িবার অভিযোগ। পক্ষপাতদুষ্টতার এই অভ্যাসে শেষন ছিলেন ব্যতিক্রম। স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের অর্থ তাহা স্বয়ং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবে, এবং রাজনীতি তাহার উপর নিয়ন্ত্রণ খাটাইতে পারিবে না, ইহাই ছিল শেষনের শেষ কথা।

এবং, শেষনের শিক্ষা বুঝাইয়া দেয়, প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এক ব্যক্তি কী রূপে জরুরি হইয়া উঠিতে পারেন। নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে পক্ষপাত ও রাজনীতিকদের সুবিধা দিবার যে অভিযোগ উঠিয়া থাকে, নিজের কালপর্বে শেষন একার দায়িত্বে সেই কলঙ্ক মুছিয়া ফেলিয়াছিলেন। কঠোর পদক্ষেপ কখনও অতিরিক্ত হইয়াছিল কি না, তাহা তর্কসাপেক্ষ, তবে পদক্ষেপ যে প্রয়োজনীয় ছিল, তাহা রাজনীতিকগণের অসহায় ক্রন্দন এবং তজ্জনিত কুবাক্য বর্ষণ হইতেই স্পষ্ট হয়। বর্তমান ভারতের দিকে চাহিলেও অবশ্য এই ধারণা বুঝা সম্ভব— এক ব্যক্তির জোরে সম্পূর্ণ তৈয়ারি ব্যবস্থাও ভাঙিয়া পড়িতে পারে। শুভ হউক বা অশুভ, স্বাতন্ত্র্যই কোনও পার্সন বা ব্যক্তিকে বা পার্সোন্যালিটি বা ব্যক্তিত্বে উত্তরণ ঘটায়। নিজের নীতির দ্বারাই সকলের ভিড়ে তাঁহাকে পৃথক করিয়া চিনিয়া লওয়া যায়। স্বতন্ত্র সাহসের বলেই ভারতের সংসদীয় নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় এক অনন্য ব্যক্তিত্ব হইয়া চির দিন উজ্জ্বল থাকিবেন টি এন শেষন।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন