দেশ থেকে পালিয়ে...

এই সব তথ্য আমাদের অচেনা নয়। এই ছবি কেন এ রকম, তা নিয়েও চিন্তা করার অধিকার আমাদের নেই।

Advertisement

ঈশা দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০১৮ ০০:১০
Share:

বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সর্বভারতীয় পরীক্ষার ফলাফল ঘোষিত হল। পরিচিত সাফল্যের সাতকাহনের মধ্যে কৃতীরা অনেকেই সদর্পে ঘোষণা করলেন তাঁরা কলকাতায় থাকতে চান না। উচ্চশিক্ষা বা চাকরি, সব ক্ষেত্রেই তাঁরা শহর বা রাজ্যের বাইরে যাওয়াটাই যুক্তিসঙ্গত মনে করেন। এই প্রবণতা এত প্রতিষ্ঠিত, এত বার উচ্চারিত যে, যখন আমরা আবারও শুনি আমাদের নতুন করে বিসদৃশ কিছু মনে হয় না। এমনটাই তো হয়— এই রাজ্যে, এই শহরে কেউ থাকে না। তথ্য বলছে, কলকাতার প্রায় চার হাজার ছাত্রছাত্রী এফ-১ ভিসা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করছেন। প্রায় চব্বিশ লাখ ভারতীয় থাকেন আমেরিকায়।

Advertisement

এই সব তথ্য আমাদের অচেনা নয়। এই ছবি কেন এ রকম, তা নিয়েও চিন্তা করার অধিকার আমাদের নেই। আমাদের কষ্টার্জিত অর্থ, যা আমরা সন্তানদের শিক্ষার জন্য ব্যয় করি, তাতেই চলমান এই ব্যয়বহুল শিক্ষা বা পরীক্ষা পদ্ধতি, অথচ কেন এত ছাত্রছাত্রী নিজেদের শহর, নিজস্ব আশ্রয় ছেড়ে দূর শহরে যাচ্ছেন, অনেক সময়েই বাধ্য হয়ে, তার জন্য কে বা কী দায়ী, তা নিয়ে আমাদের মতামতের কোনও দাম নেই।

আমরা অভিভাবকরা চিন্তিত। ছেলেমেয়ের পড়াশুনো নিয়ে, তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে, তাদের চাকরি পাওয়া না পাওয়া নিয়ে আমরা চিন্তিত। চিন্তিত বলেই না সেই স্কুলে ভর্তির সময় থেকে জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার টেবিল অবধি ছোটাছুটি চালিয়ে যাচ্ছি। বাবারা কাজে ব্যস্ত থাকলে, মা-রা ছুটছি। মা বাবা দু’জনে ব্যস্ত থাকলে দাদু ঠাকুমাকে ছোটাছুটি করাচ্ছি। ছুটতে ছুটতে ছেলেমেয়ের সঙ্গে দু’দণ্ড বসার সময় পাচ্ছি না, তার মন ভাল না খারাপ তা জানার সময় পাচ্ছি না, সে মনখারাপ করতে করতে কখনও অবসাদে ডুবে যাচ্ছে, হয়তো বা নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথাও ভাবছে, তবু আমরা ছোটা বন্ধ করছি না। মনোবিদরা, সমাজের শুভানুধ্যায়ীরা নানা ভাবে সতর্ক করছেন, কিন্তু আমরা শুনছি না।

Advertisement

সন্তানকে নিয়ে চিন্তা, উদ্বেগ স্বাভাবিক। কিন্তু তা এমন লাগামছাড়া কেন? কিছু তথ্যের দিকে তাকাই। গত দশ বছরে, আমেরিকায় ভারতীয় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার প্রায় ৬৯.৩৭%। প্রত্যেক বছর পড়াশোনার জন্য আমেরিকায় যাওয়া ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের হার বৃদ্ধি পায় প্রায় ৪%। চাকরির জন্য অন্য সব দেশীয় মানুষদের থেকে ভারতীয়রা গত দশ বছরে আমেরিকায় গিয়েছেন প্রায় ১২% বেশি।

এরই মধ্যে সম্ভবত লুকিয়ে আছে আমাদের প্রশ্নের উত্তর। দশ-বারো বছর আগেও যা ছিল কতিপয় মেধাবীর অর্জন, এখন তা সাধারণের কাছে লভ্য হয়েছে। সেই চব্বিশ-পঁচিশ লাখের মধ্যে এক জন আমার ছেলে বা মেয়ে তো হতেই পারে। পড়তে গেলে ভাল, বিয়ে করে যেতে পারলেও মন্দ নয়, চাকরি করতে গেলে তো কথাই নেই। নিজেদের চেষ্টায় যেতে পারিনি, ছেলেমেয়েদের সূত্র ধরে ঠিক গিয়ে পৌঁছব, ফোনে ছবি পোস্ট করব। নাতিনাতনির আয়া হতে হলে, হবে। সপ্তাহের পাঁচ দিন ঘরে বন্দি থাকতে হবে, পাড়া-প্রতিবেশীর সঙ্গে গল্পগাছার সময় নেই, ছেলেমেয়ের জন্য রান্না করে বাড়িঘর পরিষ্কার করে অপেক্ষা করতে হবে, তাতেও অসুবিধে নেই। শুধু ট্রাম্প লোকটি একটু বেগ দিচ্ছেন, এই যা।

আমরা বাবা-মায়েরা শুধু যে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের জন্য চিন্তিত তা নয়, লোভাতুর হয়ে পড়েছি। মানিয়ে নিয়েছি ছেলেমেয়ের অবসাদ, চিন্তিত মুখ, অশান্ত বা কখনও নেশাগ্রস্ত জীবনের সঙ্গে। এক সময় কালাপানি পেরোলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হত, এখন না পেরোতে পারলে। এবং যা সবাই করছে, তা-ই করতে হবে। গড্ডলিকা প্রবাহে বড় নিশ্চিন্তি। গড়টাই স্বাভাবিক, কক্ষচ্যুতকে দলে নেয় না কেউ। আমরা সবার মতো হতে চাই। সন্তানকেও ঠিক তেমনটাই শেখাই।

আরও একটা বছর আসবে, পরীক্ষার ফল বেরোবে। আমরা ভুলে যাব, পরীক্ষার ফল হাতে পেয়ে এক কালে সন্তানের মাথায় চুমু খেয়ে বলতে হত, “অনেক বড় হও। ভাল মানুষ হও।”

ভুলে যাওয়াই ভাল। এ সব কথায় বড় বিপদ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন