সম্পাদকীয় ১

গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ

সেই লঙ্ঘন আরও প্রকট সরকারের বিরুদ্ধে আনা তেলুগু দেশম পার্টির অনাস্থাপ্রস্তাবে ভোটাভুটি করিতে না দেওয়ায়। স্পিকার বলিতে পারেন, তিনি নিয়ম মানিয়াছেন মাত্র।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৮ ০০:৫০
Share:

২০১৪ সালের মে হইতে ২০১৮-র এপ্রিলের দূরত্ব ঠিক কত? ভারতীয় রাজনীতির সচেতন পর্যবেক্ষকরা বলিবেন, মোদীর জমানায় এই দূরত্ব কার্যত ধ্রুবক। প্রতিশ্রুতি হইতে বাস্তবের দূরত্ব যতখানি, ঠিক ততটাই। ২০১৪ সালের ২০ মে নরেন্দ্র মোদী সংসদে প্রবেশ করিবার পূর্বে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিয়াছিলেন ভবনটিকে। তিনি বলেন নাই, কিন্তু ধরিয়া লইতে বাধা নাই যে প্রণামটি সংসদ ভবনের ইট-বালি-সিমেন্টের কাঠামোটির উদ্দেশে ছিল না, ছিল ভারতীয় গণতন্ত্রের উদ্দেশে। প্রণামটিতে নিহিত ছিল একটি প্রতিশ্রুতি— গণতন্ত্রের মর্যাদা রক্ষায় ত্রুটি হইবে না। ৬ এপ্রিল শেষ হওয়া বাজেট অধিবেশন বলিয়া দিল, তাঁহার অন্য প্রতিশ্রুতিগুলির ন্যায় নরেন্দ্র মোদী এই প্রতিশ্রুতিরও কণামাত্র রাখেন নাই। ২০০০ সালের পর কখনও সংসদে কোনও অধিবেশনের এতখানি সময় নষ্ট হয় নাই। সংসদে কাজের পরিবেশ না থাকা, চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলাই ইদানীং কালে ‘স্বাভাবিক’ হইয়া উঠিয়াছে। ফলে, ক্ষতির নিরিখে এই অধিবেশন সর্বাগ্রগণ্য হইলেও তাহাতে নরেন্দ্র মোদী বিশিষ্টতা দাবি করিতে পারিবেন না। এই বাজেট অধিবেশনটি ব্যতিক্রমী, কারণ ইতিপূর্বে কোনও সরকার সংসদের বিশৃঙ্খলাকে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করিতে এমন সুচারু ভাবে ব্যবহার করে নাই। লোকসভার স্পিকার সুমিত্রা মহাজন তালিকা পেশ করিয়া জানাইয়াছেন, এই অধিবেশনে বহু বিল পাশ হইয়াছে। কিন্তু, তিনি বলেন নাই, বিলগুলি পাশ হইয়াছে বিন্দুমাত্র আলোচনা ছাড়াই। গণতন্ত্রের প্রথম শর্তটিই লঙ্ঘিত হইয়াছে।

Advertisement

সেই লঙ্ঘন আরও প্রকট সরকারের বিরুদ্ধে আনা তেলুগু দেশম পার্টির অনাস্থাপ্রস্তাবে ভোটাভুটি করিতে না দেওয়ায়। স্পিকার বলিতে পারেন, তিনি নিয়ম মানিয়াছেন মাত্র। সংসদে বিশৃঙ্খলা চলিলে প্রস্তাবের পক্ষে ও বিপক্ষে থাকা সদস্যদের সংখ্যা গণনা করা অসম্ভব। অনাস্থাপ্রস্তাবটি উঠিবার পরই এআইএডিএমকে কেন কাবেরীর জলবণ্টনের প্রশ্নে সরব ও বিশৃঙ্খল হইয়া উঠিল, সেই জল্পনা বকেয়াই থাকুক। কিন্তু, প্রয়োজনে বিশৃঙ্খল সাংসদদের বহিষ্কার করিয়া সংসদ চালাইবার সিদ্ধান্তটি সরকার করিল না কেন, সেই প্রশ্ন উঠিবেই। আস্থা ভোটে পরাজিত হইবেন, তেমন আশঙ্কা নরেন্দ্র মোদীরও সম্ভবত ছিল না। কিন্তু, তাঁহার আধিপত্যকে প্রশ্ন করিতে পারে, এমন কিছুকেই সূচ্যগ্র জমি না ছাড়িবার পণই গণতন্ত্রের এই অপমানের কারণ হইয়া দাঁড়াইল। দীনদয়াল উপাধ্যায় মার্গে সম্ভবত পরিতৃপ্তির হাওয়া খেলিতেছে। কৌশলগত ভাবে তাঁহারা জয়ী। কিন্তু, কাহাকে হারাইয়া জয়ী, ভাবিয়াছেন কি? সংসদের সিঁড়িতে সেই সাষ্টাঙ্গ প্রণামের স্মৃতি মোদীকে তাড়া করিতেছে না তো?

জাতীয় রাজনীতিতে বিবিধ প্রতিরোধের সম্মুখে বিজেপির হাত কাঁপিতেছে, সংসদের অচল বাজেট অধিবেশন কি তাহাই দেখাইল? তেলুগু দেশমের এনডিএ ত্যাগের সিদ্ধান্ত; দীর্ঘ দিনের শরিক, ভারতীয় রাজনীতিতে একমাত্র আদর্শগত বন্ধু শিবসেনার বিচ্ছেদপ্রস্তাব; মহারাষ্ট্রে কৃষকদের লং মার্চ; লোকসভার উপনির্বাচনে বিজেপির পরাজয়; এবং, নীরব মোদী-কাণ্ডে দেশব্যাপী আলোড়ন— মাত্র ত্রিশ দিনের মধ্যে এতগুলি ধাক্কা গত চার বৎসরে বিজেপি খায় নাই। ফলে, ত্রিপুরায় বাম দুর্গ দখলের আনন্দটি হাওয়ায় মিলাইয়া গিয়াছে, স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে বিজেপি নেতৃত্বের দিশাহারা মুখ। কোণঠাসা হইলে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করিবার প্রবণতা একনায়কদের চিরন্তন। নরেন্দ্র মোদী জানাইলেন, তিনিও ব্যতিক্রম নহেন। প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া অপেক্ষা আলোচনার পরিসরটিকে নষ্ট করিয়া ফেলাই তাঁহার পক্ষে সহজতর। তাহাতে যদি গণতন্ত্রের ক্ষতি হয়, তো হউক। সংসদে প্রণামটি সম্ভবত নেহাত ক্যামেরার উদ্দেশেই ছিল।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন