ক্লাব ফুটবলে একাধিক ট্রফি ও বিশ্বকাপ জেতার সুবাদে আর্জেন্টিনার তারকা ফুটবলার লিয়োনেল মেসি পেলে বা মারাদোনার মতোই বিশ্বে ফুটবলভক্তদের কাছে ‘ফুটবলের রাজপুত্র’ বলে অভিহিত হন। সম্প্রতি বাংলার গর্ব যুবভারতীতে নির্লজ্জ ক্ষমতাবান ছবিলিপ্সুদের ভিড়ে মেসির ‘ফিল্ড-শো’ পণ্ড হওয়ায় বিদেশে এ খবর ফলাও করে প্রচার হতে বেশি দেরি হয় না। যে ভাবে শাসক দলের কেষ্টবিষ্টুদের হামলে পড়তে দেখা গিয়েছে, মেসি, সুয়ারেজ় ও রদ্রিগো ডি পলের সুরক্ষা বিঘ্নিত হওয়া অসম্ভব কিছু ছিল না। অথচ এই বাংলাতেই অতীতে পেলে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে গিয়েছেন, ক্রীড়ামোদী দর্শক সুশৃঙ্খল ভাবে মারাদোনা, মেসি, অলিভার কানকে দেখতে পেয়েছেন। এ বারের ঘটনার কারণে অতীতের সব গর্ব ম্লান হয়ে গেল আয়োজক, ক্রীড়া দফতর ও পুলিশ প্রশাসনের যৌথ অপদার্থতায়। হাজার হাজার টাকা খরচ করে দূরদূরান্ত থেকে পাড়ি দিয়ে ফুটবলপ্রেমী মানুষ গ্যালারিতে হাজির হয়েছিলেন মেসিকে এক ঝলক দেখবেন বলে। কিন্তু মেসিকে ঘিরে থাকা ক্ষমতাতন্ত্রের ভিড়ে তাঁদের সেই মনোবাঞ্ছা অপূর্ণ থেকে গেল। চূড়ান্ত অব্যবস্থার জেরে কুড়ি মিনিটের মধ্যে মেসি মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন, মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় ফিরে যায়।
তদন্ত কমিটির রিপোর্ট এবং সুপারিশ ভবিষ্যতের গর্ভে। তবে এই অব্যবস্থার জন্য শুধুমাত্র ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট গ্রুপের ব্যর্থতাকে দায়ী করা যায় না। কেননা, এই গ্রুপের কর্ণধার গ্রেফতার হওয়ার পরও হায়দরাবাদ, মুম্বইয়ের অনুষ্ঠান নির্ঘণ্ট অনুযায়ী নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়। বরং নেতাতন্ত্রের গা-জোয়ারি মনোভাব এখানে তারকার চার পাশে যে চক্রব্যূহ তৈরি করেছিল, মেসি স্বয়ং তা কাটিয়ে বেরোতে পারেননি।
পাড়ার ইমারতি ব্যবসা থেকে টালিগঞ্জের স্টুডিয়ো পাড়া, আর জি কর থেকে এসএসসি, রেশন-কয়লা-গরু পাচার থেকে মেসি— সর্বত্রই ক্রিয়াশীল শাসক দলের স্নেহধন্য সিন্ডিকেটরাজ। “পপুলিজ়ম বা জনপ্রিয়তাবাদ কিছু কিছু সময়ে ভাল, কিন্তু তা যখন নিজেকে বাড়াতে বাড়াতে পরিণত হয় চালাকি আর অদূরদর্শিতায়, তখন তার গুরুত্ব কমে আসে। এই সময়ে সমাজের চিড় ও ফাটলগুলো নিষ্ঠুর ভাবে উন্মোচিত হয়ে যায়”— এই সংবাদপত্রে রণবীর সমাদ্দারের ‘তবু আলোচনার বিকল্প নেই’ (২০-৬-১৭) প্রবন্ধে প্রকাশিত মন্তব্যটি দিয়ে যুবভারতী কাণ্ডও ব্যাখ্যা করা যায়।
সি নর্থকোট পার্কিনসন একদা বলেছিলেন, কোনও বিষয়কে ধামাচাপা দেওয়ার শ্রেষ্ঠ উপায় একটি কমিটি বসিয়ে দেওয়া। একমাত্র মেসি-কাণ্ডের মূল মাথাদের চিহ্নিত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারলে বাংলার ফুটবলপ্রেমী প্রতারিত দর্শকেরা হাজার হাজার টাকার শোক সামলে উঠতে পারবেন।
রাজশেখর দাশ, কলকাতা-১২২
মাথা হেঁট
লিয়োনেল মেসির কলকাতায় আগমনকে ঘিরে ঘটে যাওয়া চূড়ান্ত লজ্জাজনক ঘটনা আমাদের কাছে বিষম গ্লানিকর। কলকাতা বাদে হায়দরাবাদ, মুম্বইতেও মেসি দর্শনের অনুষ্ঠান ছিল। কিন্তু সেখানে এই রকম কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি ঘটেনি, বরং সাফল্যের সঙ্গে অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে। বাঙালি বরাবরের আবেগপ্রবণ। রবিঠাকুরের শেষ যাত্রাই হোক, বা কপিলদেবের টেস্ট থেকে বাদের ব্যাপার হোক। সেটা কি উদ্যোক্তা বা প্রশাসন জানত না? উন্মাদনা মেসিকে নিয়ে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এর আগেও মেসি, মারাদোনা, পেলে কলকাতায় এসেছেন। কিন্তু এই মাপের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তো হয়নি? কারণ, উদ্যোক্তা এবং প্রশাসনের সমন্বয় ছিল ভাল। সত্যি বলতে, বর্তমান সমাজে সেলফি তোলার যে কী বিষম কুফল এবং তা রাজ্যের নেতা-মন্ত্রীদের মধ্যেও যে কী ভয়ঙ্কর ভাবে সংক্রমিত, তা সমাজমাধ্যমে নজর দিলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। আসল কথা হল, কে দায়ী? প্রশাসন না উদ্যোক্তা? এই নিয়ে বহু চাপানউতোরের মধ্যেও কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়, কেন ২০ টাকার জলের দাম ২০০ টাকা? পুলিশের উপস্থিতি সত্ত্বেও প্রায় ২০০ কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি নষ্ট হল কী ভাবে? মেসির এত কাছে মন্ত্রীরা কেন? উদ্যোক্তারা কোনও পাঁচতারা হোটেলে নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে পরিচয় করাতে পারতেন, না কি এখানেও সেই দেখানোর রাজনীতি?
মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী যে তদন্ত কমিশন গঠন করেছেন, সেটা কি সত্যি অপরাধীদের শাস্তি বিধানের জন্য, না কি আপৎকালীন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য? রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রীর আচরণে মনে হচ্ছিল তিনিই মূল উদ্যোক্তা। মন্ত্রী থাকলেই তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরাও যে থাকবে, সেটা কি তিনি জানতেন না? কষ্টের পয়সা দিয়ে চড়া মূল্যে সবাই টিকিট কেটেছিলেন। তাই হয়তো বহিঃপ্রকাশ বেশি হয়েছে, অন্য কোনও উপায়ে পরিস্থিতি কি সামাল দেওয়া যেত না?
বার বার কেন শতদ্রু দত্তরাই বলির পাঁঠা হবেন? আর কত দিন এঁদের সামনে রেখে বড় মাথারা নাগালের বাইরে থাকবেন?
স্বপন চক্রবর্তী, জগৎবল্লভপুর, হাওড়া
কালো দিন
“আর একটি ‘পালক’” (১৬-১২) শীর্ষক সম্পাদকীয় যথাযথ। গত ১৩ ডিসেম্বর বাংলা ক্রীড়াঙ্গনের একটি কালো দিন হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সারা দেশের কাছে মাথা নত হল বাংলার। অন্য রাজ্যে কিন্তু সুষ্ঠু ভাবেই সব সম্পন্ন হল। শুধু এখানে নেতা-পুলিশদের অপদার্থতায় একটি নতুন কলঙ্ক-পালক জুড়ল বাংলার মুকুটে। মেসি-উন্মাদনা কলকাতায় স্বাভাবিক। কারণ বাঙালি ফুটবলপ্রেমী বেশি মাত্রায় আবেগপ্রবণ। মেসির মতো এক জন বিশ্ববরেণ্য ফুটবলারকে নিজের চোখে দেখে স্মৃতিতে ধরে রাখতে হাজার হাজার টাকা তাঁরা খরচ করেছেন। কিন্তু নেতা ও তাঁদের ঘনিষ্ঠরা মৌমাছির মতো সে দিন মেসিকে এমন ভাবে ঘিরে রইল যে, গ্যালারি থেকে ফুটবলের রাজপুত্রকে কেউ দেখতেই পেলেন না। মেসি ও তাঁর নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষীরা কুড়ি মিনিট বাদেই মেসিকে নিরাপত্তার স্বার্থে মাঠ থেকে বার করে নিয়ে গেলেন। স্বভাবতই দর্শকদের ক্ষোভে তছনছ হল স্টেডিয়ামের অনেক কিছু। গোটা ঘটনায় আগে থেকে কোনও সুচিন্তিত পরিকল্পনা ছিল বলে মনে হল না। যথারীতি ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গড়া হল, দু’-চার জনকে পাকড়াও করা হল। কিন্তু কলকাতার এই বদনাম কি মুছবে? ভবিষ্যতে কলকাতায় কোনও বড় খেলার আয়োজন করতে কর্তৃপক্ষ দশ বার ভাববেন।
অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা-৮৪
অসম্মান
দীর্ঘ পনেরো বছরেরও বেশি সময় ধরে আমি ইডেন গার্ডেন্সে আইপিএল, টেস্ট এবং ওয়ান ডে ম্যাচ দেখতে নিয়মিত যাই এবং ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসার টানে ইংল্যান্ডে ক্রিকেট বিশ্বকাপও দেখতে গিয়েছিলাম। অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, এত বড় স্টেডিয়ামে প্রিয় খেলোয়াড়দের খুব কাছ থেকে দেখা যায় না। মূল বিষয়টা হল, মাঠে তাঁদের উপস্থিতি অনুভব করা এবং এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হওয়া। ঠিক এই কারণেই, গত ১৩ ডিসেম্বর যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের মতো বিশাল স্টেডিয়ামে লিয়োনেল মেসির মতো এক জন বিশ্বমানের তারকা ফুটবলারকে পরিষ্কার ভাবে দেখা যাবে না, এটা স্বাভাবিক। তাই, তারকাদের ঘিরে দর্শকদের ভিড় করা বা উন্মাদনা দেখানোকে শুধুমাত্র ‘বিরক্তিকর’ আখ্যা না দিয়ে, আমাদের এর অন্য দিকটিও বিবেচনা করা উচিত। এক জন তারকাকে যদি কেউ ঘিরে না থাকে, তবে তাঁর নিরাপত্তা কোথায়? তাঁর উপর কোনও আক্রমণ হলে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের সম্মান কোথায় গিয়ে দাঁড়াত? এই প্রসঙ্গে, আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত শতদ্রু দত্তকে গ্রেফতারের বিষয়টি আমাকে বিস্মিত করেছে। যে মানুষটি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিমানযাত্রা করে সুদূর ব্রাজ়িলে গিয়ে একাধিক ফুটবলারকে অনুরোধ করে কলকাতায় আনলেন, তাঁকেই এই ধরনের পরিস্থিতির শিকার হতে হল?
শৌনক দাস, শ্রীরামপুর, হুগলি
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে