উৎসব-পার্বণে লম্বা ছুটি নেওয়া বাঙালির কর্মসংস্কৃতি নিয়ে কটাক্ষের অন্ত নেই। আঠারো শতকের কলকাতা নিয়ে গেলে এই সমালোচকদের চোখ কপালে উঠত। কলকাতায় বড়দিন উপলক্ষে সাহেবদের খানাপিনা নাচগান কেনাকাটার হুল্লোড় চলত দিন দশেক ধরে! ১৭৮৮ সালে ক্রিসমাস পড়েছিল এক বৃহস্পতিবার। ক্যালকাটা গেজ়েট-এর খবর, টাউন কলকাতার উৎসব আরম্ভ হয়েছিল আগের সোমবার থেকেই, বড়লাটের দেওয়া বলনাচ ও ভোজের মাধ্যমে। সেই অনুষ্ঠানের টানে দু’জন সম্ভ্রান্ত মহিলা নিজেদের বিলেতে ফিরে যাওয়ার তারিখও পিছিয়ে দেন। তারও আগের দশকে বড়লাটের আমন্ত্রণে তিন বেলা ভোজের আয়োজন ছিল বড়দিনে। সেটি উৎসবের প্রথম পর্ব। দ্বিতীয় পর্বটি পালিত হত পয়লা জানুয়ারি বা নিউ ইয়ার্স ডে-তে। রাত পেরিয়ে পরের দিন পর্যন্ত চলতে থাকা সেই উদ্যাপনে গা ভাসাতেন সাহেব-মেমরা। ভোজসভায় স্বাস্থ্যপানের ‘চিয়ার্স’ প্রতিধ্বনিত হত বাইরের মুহুর্মুহু তোপধ্বনিতে।
উনিশ শতকের প্রথম দিকে কলকাতায় বেশ কিছু দিন কাটিয়ে যাওয়া ফ্যানি পার্কস তাঁর জার্নালে লিখেছেন, সাহেবদের বাড়িতে নিযুক্ত বেয়ারা, সহিস বা ধোপার মতো নানান সহায়ক বড়দিনে ফুলমালা আর কলাগাছ দিয়ে বাড়ি সাজিয়ে দিতেন। তার পর সুন্দর করে সাজানো পাত্রে আপেল বা কমলালেবুর মতো ফল বা কিসমিস, আখরোট, মিষ্টি ইত্যাদি উপহার হিসেবে তুলে দিতেন মেমসাহেবের হাতে। প্রত্যাশা থাকত বকশিশের।
ক্রিসমাস ও নিউ ইয়ারের শুভেচ্ছাবার্তা ছাপা ‘গ্রিটিংস কার্ড’ কলকাতার বাজারে পাওয়া যেতে শুরু করে উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে। ইউরোপের দৃশ্যের পরিবর্তে স্থানীয় জনজীবনের ছবি-সম্বলিত সে সব কার্ড হয়ে উঠল উৎসবের মরসুমে কলকাতার নিজস্ব অভিজ্ঞান। ডালহৌসি স্কোয়ারের ডব্লিউ নিউম্যান অ্যান্ড কোম্পানি এক আনা থেকে পাঁচ টাকা দামের গ্রিটিংস কার্ড বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়েছিল ১৮৮৩ সালের সংবাদপত্রে।
ইটালীয় অপেরা আর ‘ব্ল্যাকফেস মিন্সট্রেলস’ আমেরিকান গানের দলের সঙ্গে, শহরের টাউন ব্যান্ডের সঙ্গীতেও মেতে উঠত সাহেবি কলকাতার উৎসব। সঙ্গে থাকত উইলসন’স আর স্পেন্স’স হোটেলের সুখাদ্য ও পানীয়। উৎসবের অঙ্গ ছিল উপহার আদানপ্রদান, বিশেষ ক্রিসমাস-পসরার বিজ্ঞাপন পড়ত। ১৮১১ সালের কাগজে একটি বিজ্ঞাপনে দেখা মেলে আমদানি করা ম্যাজিক ল্যান্টার্ন, বই, পুতুল, বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদির সম্ভার। মহিলা ও বাচ্চাদের উপযোগী জিনিসের তালিকাটা বেশি লম্বা। উনিশ শতকের শেষ দিকে বড়দিনের বাজার করার সেরা ঠিকানা হয়ে ওঠে নিউ মার্কেট। বনবন বা প্লাম কেকের মতো বড়দিনের পসরার পাশে, ফুল আর রাংতার মালায় সেজে উঠত নিউ মার্কেট। ক্রিসমাসের আগের দিন ভোর থেকেই বাজারে ক্রেতার ভিড়। সাহেবি সংস্কৃতির অনুসরণে শুরু হলেও, ধীরে ধীরে কলকাতার বড়দিন হয়ে ওঠে সব সম্প্রদায়ের মানুষের উৎসব। ইতিহাসের নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তবেই সে এসে পৌঁছেছে আজকের জায়গায়। পার্ক স্ট্রিটের আলোকসজ্জার মতোই, সেই ইতিহাসও চমকপ্রদ। ছবিতে একালের কলকাতায় বড়দিন ও নিউ ইয়ারের উৎসব-সন্ধ্যা।
চর্চার ছয় দশক
রবীন্দ্রচর্চার জন্য স্থায়ী একটি কেন্দ্রের প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন সোমেন্দ্রনাথ বসু। সেই ভাবনাই রূপ পায় ‘টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এ, গোড়াপত্তন ১৯৬৫-র ১ জানুয়ারি। তার পর কেটে গেছে ছ’টি দশক, ১৯৮০-র ৪ মে থেকে কালীঘাট পার্কের রবীন্দ্রচর্চা ভবন হয়ে উঠেছে কলকাতায় রবীন্দ্র-জীবন, দর্শন ও সৃষ্টি নিয়ে মননশীল ভাবনাচিন্তা আর চর্চার কেন্দ্র; গ্রন্থাগার, প্রকাশনা, মেলা-প্রদর্শনীর আয়োজনে কর্মমুখর। ইনস্টিটিউটের ষাট বছর পূর্তিতে কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে দু’দিন ব্যাপী অনুষ্ঠান ওঁদের সভাকক্ষে। ৩১ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে ৫টায় রবীন্দ্রঙ্গীতের গায়কির বিবর্তন নিয়ে বলবেন প্রমিতা মল্লিক অলক রায়চৌধুরী ও স্বপন সোম, কথা-সমন্বয়ে অভ্র বসু। শোনা যাবে প্রাসঙ্গিক গানও। ১ জানুয়ারি একই সময়ে সন্মাত্রানন্দ বলবেন ‘সুভা’, ‘সম্পত্তি সমর্পণ’, ‘মণিহারা’: প্রকৃত, প্রাকৃত, অতিপ্রাকৃত’ নিয়ে, পরে রাজশ্রী ভট্টাচার্যের নিবেদন ‘গানের রক্তকরবী’। ভাবগম্ভীর, অনন্য সন্ধ্যা।
স্মরণে-মননে
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমিয়কুমার বাগচী ছিলেন ইন্সটিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ় কলকাতা-র (আইডিএসকে) প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক। এ বছর আইডিএসকে-তে শুরু হল তাঁর নামাঙ্কিত স্মারক বক্তৃতা, গত ২২ ডিসেম্বর প্রথম বক্তৃতাটি দিলেন জেএনইউ-এর প্রাক্তন অধ্যাপিকা সুনন্দা সেন, ‘লিগ্যাসিজ় অব অমিয়কুমার বাগচী: অন কোয়েশ্চেনিং দ্য লেজিটিমেসি অব প্রিভেলিং অর্থোডক্সি অ্যান্ড ইটস হিস্টোরিক্যাল অ্যান্টিসিডেন্টস’ নিয়ে। অমিয়কুমারের অর্থনৈতিক ইতিহাস চর্চার দর্শন নিয়ে অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও রামকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় একটি বাংলা পুস্তিকাও প্রকাশ পেল, তাতে লিখেছেন অর্থনীতি ও ইতিহাসের শিক্ষক, ফলিত সমাজ-বিশ্লেষকেরা।
শুভারম্ভ
“জন্ম হয়েছিল শিবসাগরে— আসামের একটা জেলাশহরে,” সিলেট কন্যার আত্মকথা শুরুটাই এ ভাবে। এ বইয়ের লেখিকা বিজয়া চৌধুরী অবশ্য বেশি পরিচিত ওঁর গানের সুবাদে: ১৯৬৫-তে এইচএমভি থেকে প্রথম রেকর্ড, পরেও বেরিয়েছে বহু রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড, সন্তোষ সেনগুপ্ত সুবিনয় রায় অর্ঘ্য সেন প্রমুখের পরিচালনায়। গেয়েছেন অতুলপ্রসাদ নজরুল হিমাংশু দত্তের গানও, হিন্দি ভজনের তিনটি অ্যালবাম প্রকাশিত মুম্বই থেকে। শিল্পীর জন্মশতবর্ষে (জন্ম ১৯২৫) একটি ওয়েবসাইট তৈরি হয়েছে সম্প্রতি, www.bijoyachaudhuri.com। সেখানে রয়েছে শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় অমিতাভ চৌধুরী এবং শিল্পীর ছেলে, লেখক অমিত চৌধুরীর করা ওঁর গানের আলোচনা, আত্মকথার অংশ, এমনকি ওঁর করা রান্নার রেসিপিও!
প্রাসঙ্গিক
“আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ মহলে পত্রিকায় লেখার জন্য যোগাযোগ করলে বুঝতে পারি, প্রায় একশো বছর আগের রবীন্দ্রনাথের রাশিয়া যাত্রা এবং পরবর্তী পর্ব নিয়ে যে বিতর্কের সূচনা হয়েছিল, আজও তার অবসান হয়নি,” অন্বেষা পত্রিকার সাম্প্রতিক সংখ্যায় সম্পাদকীয় মন্তব্য। ১৯৩০-এ রবীন্দ্রনাথের রাশিয়া সফর ও রাশিয়ার চিঠি-কে ফিরে দেখেছে শহরের দক্ষিণে এক আবাসন থেকে প্রকাশিত ভিন্নধারার পত্রিকাটি। রুশ সমবায় পদ্ধতি দেখে বঙ্গে রবীন্দ্রনাথের তা প্রয়োগের ভাবনা; রাশিয়ার চিঠি-র চুম্বকে রবীন্দ্রভাবনায় শিক্ষা রাজনীতি সমাজতন্ত্র ব্যক্তিস্বাধীনতা নিয়ে নিবন্ধের পাশে রুশ ভারততত্ত্ববিদ সের্গেই সেরেব্রিয়ানি, ভাষাতত্ত্ববিদ নীলাক্ষী সূর্যনারায়ণ, অধ্যাপক মোহাম্মদ এ কাইয়ুমের সাক্ষাৎকার।
মনে রেখে
১৮৯৫-এর ২৮ ডিসেম্বর, প্যারিসের গ্র্যান্ড ক্যাফে-তে অগাস্ত ও ও লুই লুমিয়ের সূচনা করেন বাণিজ্যিক ভাবে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের। নতুন শিল্পমাধ্যম সিনেমার যাত্রা শুরু হল, জুড়ল বাণিজ্য-ভাবনাও। প্রথম ‘সিনেমা’ দেখানোর সেই ‘ঐতিহাসিক’ দিনটি ‘বিশ্ব চলচ্চিত্র দিবস’ হিসেবে উদ্যাপন করবে ভবানীপুর ফিল্ম সোসাইটি। আগামী কাল বিকেল সাড়ে ৪টায় নন্দন-৩ প্রেক্ষাগৃহে তাদের উদ্যোগ: সিনেমা নিয়ে আলোচনা, ছবির প্রদর্শন। দিল্লির ইজ়রায়েলি দূতাবাসের সহযোগিতায় আজ ও কাল দু’দিন ব্যাপী ইজ়রায়েলি চলচ্চিত্র উৎসবকে তারা জুড়ে নিয়েছে সঙ্গে। আজ বিকেল সাড়ে ৪টায় ও ৬টায় হিয়ার উই আর ও আফটারথট ছবিদু’টি; আগামী কাল আলোচনা-শেষে বিকেল সাড়ে ৫টায় দেখানো হবে রিয়েল এস্টেট ছবিটি।
আঁকায়, লেখায়
শিল্পী-শিক্ষক কে জি সুব্রহ্মণ্যনের জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে গত বছর। ভারতের নানা প্রদর্শশালা, প্রতিষ্ঠান ও শিল্পী-সমাজ শ্রদ্ধা জানিয়েছে তাঁকে, তাঁর আঁকা ও গড়া শিল্পকর্মের প্রদর্শন ও আলোচনার মধ্য দিয়ে। শান্তিনিকেতনের অদূরে শিল্পীদের তৈরি আবাস ‘শান্তিনিকেতন সোসাইটি অব ভিস্যুয়াল আর্ট অ্যান্ড ডিজ়াইন (স্বাদ)’ জন্মলগ্ন থেকেই পেয়েছে সবার প্রিয় ‘মানিদা’র সঙ্গ ও সমর্থন— জন্মশতবর্ষে তার সদস্যেরা ভেবেছিলেন ভিন্নধারার এক পরিকল্পনা: শিল্পীর ছাত্রছাত্রী, বন্ধু, সহকর্মী ও আত্মজন ওঁর সম্পর্কে অনুভব প্রকাশ করুন নিজেদের হাতের লেখা ও আঁকায়, তা নিয়েই হবে প্রদর্শনী। বিপুল সাড়া পড়ে তাতে। সেই প্রদর্শনীটিই এ বার শহরে, যতীন দাস রোডের গ্যাঞ্জেস আর্ট গ্যালারিতে, চলছে ১৬ ডিসেম্বর থেকে। পঙ্কজ পানওয়ার ও দিলীপ মিত্রের কিউরেশনে শতাধিক শিল্পী ও গবেষকের শ্রদ্ধার্ঘ্য ‘আ ট্রিবিউট টু মানিদা’ (ছবিতে একটি), ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত। রবিবার বাদে গ্যালারি খোলা রোজ সকাল ১১টা থেকে সন্ধে ৭টা।
কান্ত-গাথা
গলায় ক্যানসার, অস্ত্রোপচার হয়েছে। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রজনীকান্ত সেন (ছবি) পেনসিলে লিখতেন মনের কথা। একটি খাতার ১৭ নং পৃষ্ঠায় মেলে, ‘দাও, ভেসে যেতে দাও তারে’। সেই খাতা-সহ কান্তকবির হাতে লেখা কাব্য-পাণ্ডুলিপির আরও দু’টি খাতা পেল ‘জীবনস্মৃতি আর্কাইভ’, প্রাতিষ্ঠানিক সংরক্ষণের লক্ষ্যে। দিলেন রজনীকান্তের দৌহিত্র, সঙ্গীতগুণী দিলীপকুমার রায়ের শিষ্যা অর্চনা ভৌমিক; সঙ্গে কবি ও রায়-পরিবারের কাগজপত্র, বই, নানা স্মৃতিচিহ্নও। তাঁকেই এ বছরের ‘জীবনস্মৃতি সম্মাননা’য় ভূষিত করছেন আর্কাইভ কর্তৃপক্ষ। নির্বাচিত কিছু স্মারক নিয়ে একটি প্রদর্শনীরও আয়োজন করেছেন ওঁরা, ২৮ ডিসেম্বর থেকে সপ্তাহব্যাপী, ১২টা-৪টা, ভদ্রকালীর ৭০ রাম সীতা ঘাট স্ট্রিটে। উদ্বোধন কাল বিকেল সাড়ে ৫টায়।
পার্বণ-নাট্য
“মধ্যবিত্ত জীবনের নিম্নতম স্তর থেকে জীবনকে দেখার অভিজ্ঞতায় সমাজের কতটা খুলে ধরা যায় তার দৃষ্টান্ত চেখভের নাটক,” বলছিলেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। বাঙালির সাংস্কৃতিক মনকে বিশ্ববোধে উপনীত করতে, অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস সভাঘরে ১ জানুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় তিনি বলবেন আন্তন চেখভ নিয়ে; পরে নাটকের গান, সম্মাননা। আয়োজক ‘অন্য থিয়েটার’-এর তরফে বিভাস চক্রবর্তী জানালেন, বর্ষশেষের ‘নাট্যস্বপ্নকল্প’ উদ্যাপনও চেখভ ঘিরে। দু’টি নাটক, ৩০ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় অ্যাকাডেমিতে সুমন মুখোপাধ্যায় নির্দেশিত ভানু, ৩১ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় গিরিশ মঞ্চে দেবাশিস পরিচালিত পুনর্জন্ম। অন্য দিকে, ৩১ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ৯টা থেকে ‘ইচ্ছেমতো’র উদ্যোগে অ্যাকাডেমিতে রাতভর হবে জাতীয় নাট্যোৎসব ‘পার্বণ’: ব্যতিক্রম, শূন্য শুধু শূন্য নয়, চলো যাই আনন্দের বাজারে, কাব্যে গানে, মুক্ত নিসংগ, গম্ভীরা, মন্টু ও মার্ক্স-এর মতো উপস্থাপনায় সাজানো।
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে