Newsletter

কাশ্মীরের আসল মুখ এইটাই

একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রশিক্ষিত এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনী এই রকম আচরণ করতে পারে! নাগরিকের এমন চূড়ান্ত অবমাননা ঘটাতে পারে!

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০১৯ ০০:৪৭
Share:

আতিফের মা শরিফ বানো। ছবি- পিটিআই

বছর দুয়েকের ব্যবধান, দুটো ঘটনা আর একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হওয়ার অনুভূতি। এই বৃত্ত যেন এক বৃত্তাকার মায়াদর্পণ, ভারতের যে কোনও প্রান্তে বসে যে দর্পণে দেখা যায় কাশ্মীরের পূর্ণাবয়ব মুখ। খণ্ডিত মুখচ্ছবির বিভ্রান্তি কেটে যায়।

Advertisement

২০১৭ সালে উপত্যকা থেকে আসা এক ছবি কাঁপিয়ে দিয়েছিল মানবাত্মাকে। পাথরবাজির হাত থেকে বাঁচতে সাধারণ এবং নিরীহ নাগরিককে গাড়ির সামনে বেঁধে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন নিরাপত্তা বাহিনীর এক আধিকারিক। গোটা কাশ্মীর ফুঁসে উঠেছিল সে দিন। নিন্দায় সরব হয়েছিল গোটা ভারত। গোটা বিশ্ব বিস্মিত হয়েছিল। একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রশিক্ষিত এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনী এই রকম আচরণ করতে পারে! নাগরিকের এমন চূড়ান্ত অবমাননা ঘটাতে পারে! এ ভাবে মানবতাকে অপমান করা যায়! বিহ্বল বিস্ময়ে অনেকেই এই সব প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছিলেন।

অনেকে আবার ভিন্ন সুরও ধরেছিলেন। অজুহাত পেলেই কাশ্মীরিরা নিরাপত্তা বাহিনীকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করেন, আম কাশ্মীরিরাও জঙ্গিদের সঙ্গে যোগসাজশ রেখে চলেন— এমন নানা তত্ত্ব ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। স্বঘোষিত ভাবে যাঁরা জাতীয়তাবাদ এবং দেশপ্রেমের 'রক্ষক' হয়ে ওঠেন আমাদের দেশে মাঝেমধ্যেই, এই সব তত্ত্ব যে তাঁদেরই ভাসিয়ে দেওয়া, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ কমই।

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

আরও পড়ুন: আমার ছেলেটাকে মৃত্যুর মুখে দিও না, হত কিশোরের মায়ের আর্তি কানেও তোলেনি ২ লস্কর জঙ্গি

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

দেশপ্রেম আর জাতীয়তাবাদের সেই স্বঘোষিত ইজারাদারদের আজ বড় দুর্দিন। কারণ কাশ্মীরের খণ্ডিত মুখচ্ছবিটা আর দেখানো যাচ্ছে না। নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ বছর দুয়েক আগে উঠেছিল, সেই একই অভিযোগ জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ওঠার পরেও গোটা কাশ্মীর সেই ভাবেই উত্তাল। গোটা উপত্যকা ক্ষোভে, আক্রোশে ফেটে পড়ছে। কৈশোরেও পা রাখেনি যে আতিফ শফি, তাকে ঢাল বানিয়ে পুলিশের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা এবং শেষে তাকে খুন করা— হাজিনের এই ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা কাশ্মীরকে। লস্কর জঙ্গিদের ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা এবং বর্বরতার বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ শুরু হয়েছে উপত্যকার নানা অংশে। শয়ে শয়ে কাশ্মীরি রাস্তায়, তীব্র ধিক্কার লস্করকে, অঘোষিত বনধের চেহারা নানা জনপদে।

জঙ্গিদের হাতে হাজিনের আতিফ শফির হত্যা একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ করল, যে বৃত্তটার সূত্রপাত ঘটেছিল বছর দুয়েক আগে নিরাপত্তা বাহিনীর গাড়ির সামনে এক আম নাগরিককে বেঁধে মানব ঢাল তৈরির চেষ্টা হওয়ায়। বাহিনী ওই মানব ঢালকে খুন করেনি। জঙ্গিরা যখন বুঝতে পেরেছে বাঁচার কোনও পথ নেই, তখন স্বভাবসিদ্ধ নৃশংসতার আশ্রয় নিয়ে বালক আতিফকে মেরে ফেলেছে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। কিন্তু এই ঘটনা আম-কাশ্মীরির আসল মুখটাকেও দেখিয়ে দিল, অনেক বিভ্রান্তিকে গুঁড়িয়ে দিল।

একজন আম কাশ্মীরিও ভারতের অন্য যে কোনও প্রদেশের নাগরিকের মতো একটা সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন চান, নিজের পারিপার্শ্বিকতায় স্থিতিশীলতা চান, শান্তিতে-নিরুপদ্রবে বাঁচতে চান। কিন্তু উপদ্রব বছরভর তাঁর জীবনে। দশকের পর দশক ধরে সেনা-জঙ্গি লড়াইয়ের মাঝে পিষ্ট সে। বুটের শব্দ, গুলির আওয়াজ, বিস্ফোরণের অভিঘাত, বারুদের গন্ধ— বাতাস ভারী সব সময়। কখনও জঙ্গির রক্তচক্ষু। কখনও নাকা তল্লাশির নামেও হয়তো বাড়াবাড়ি। কখনও বাড়িটাই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সেনার জঙ্গি বিরোধী অভিযানে, যে বাড়িতে গৃহকর্তা হয়তো স্বেচ্ছায় আশ্রয় দেননি সন্ত্রাসবাদীদের, উদ্যত কালাশনিকভের সামনে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছিলেন।

আম কাশ্মীরির এই মুখটাকে দেখতেই পান না অনেকে, বা হয়তো দেখতে চান না। সবাইকে জঙ্গি বলে চিহ্নিত করে দিতে চান একঢালা। আতিফ শফির মায়ের বিলাপ, তার প্রতিবেশীদের চোখেমুখে তীব্র ক্ষোভ, উপত্যকা জুড়ে ঘৃণা বর্ষণ সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে আজ চোখে আঙুল দিয়ে অনেককে দেখিয়ে দিল— আম কাশ্মীরিরা জঙ্গিদের সমর্থক নন বা নিরাপত্তা বাহিনীর বিরোধী নন। লড়াইটা তাঁদের আসলে দশকের পর দশক ধরে চলতে থাকা অস্থিরতার বিরুদ্ধে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন