ফের সামনে চলে এল হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি।
আবার সে এসেছে ফিরিয়া’— ফিরে এল বটে, তবে জমল না। ‘এসেছে ফিরিয়া’ তত্ত্বেই আপাতত সংসদে নাকচ হয়ে গেল হিন্দি-বিতর্ক। সংবিধান রচনাকালে এবং ষাটের দশকে, দু’বারই এই বিতর্কে ফাটাফাটি হয়েছিল আইনসভায়। অতি-জাতীয়তার কালে আবার তাকে খুঁচিয়ে তোলা হল।
অগস্টের গোড়ায় রাজ্যসভার সাংসদদের ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সাংসদ হরনাথ সিংহ যাদব বললেন, ‘‘হিন্দি আমাদের রাষ্ট্রভাষা। কারও যে হেতু সেটা বুঝতে সমস্যা নেই, সুতরাং সংসদের নথিপত্র প্রাথমিক ভাবে হিন্দিতেই হওয়া উচিত। পরে প্রয়োজনে তা অনুবাদ করা যেতে পারে।’’ কংগ্রেস সাংসদ এল হনুমানতাইয়া জানালেন, তা হলে সংবিধানের অষ্টম তফসিলে উল্লিখিত ২২টা ভাষাকেই সংসদে সমান মর্যাদা দিতে হবে। নথিও প্রকাশ করতে হবে প্রত্যেকটা ভাষায়। সিপিআই সাংসদ বিনয় বিশ্বম বললেন, ‘‘আমরা হিন্দি ভালবাসি কিন্তু সেটা চাপানো উচিত নয়।’’ বিতর্কে ইতি পড়ল আরজেডি সাংসদ মনোজ ঝা-র বক্তব্যে— ভারতের সংবিধান সভায় এ নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হয়েছে। পুরনো কাসুন্দিকে কেন্দ্র করে ওরিয়েন্টেশনে দ্বন্দ্ব কাম্য নয়।
পুরনো কাসুন্দিতে চোখ বোলালে দেখা যাবে, ১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারি সংবিধান বলবৎ হওয়ার ১৫ বছর পর সরকারি ভাষা হিসেবে শুধু হিন্দির প্রস্তাবে প্রবল প্রতিবাদ করেছিল তামিলনাড়ুর ডিএমকে। তাকে প্রশমিত করতে ‘সরকারি ভাষা আইন ১৯৬৩’ চালু করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। সরকারি কাজে কী কী ভাষা ব্যবহার করা যেতে পারে তার একটা তালিকা তৈরি হয়েছিল। ১৯৬৭-তে আইন সংশোধনে স্পষ্ট বলা হয়েছিল— যত ক্ষণ না প্রতিটি রাজ্য ও কেন্দ্রীয় আইনসভা হিন্দিকে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব নিচ্ছে, তত ক্ষণ ইংরেজির ব্যবহার বন্ধ করা চলবে না। আবার, এর পরের বছর ‘থ্রি ল্যাঙ্গোয়েজ ফর্মুলা’ তৈরি করল মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক। ফর্মুলা অনুসারে, সব রাজ্যের শিক্ষার্থীকে তিনটি ভাষার পাঠ নিতে হবে। হিন্দি ও ইংরেজি বাদে অহিন্দিভাষীরা শিখবে আঞ্চলিক ভাষা আর হিন্দিভাষীরা শিখবে আধুনিক ভারতীয় ভাষা। সেখানে দক্ষিণ ভারতীয় ভাষা থাকাই বাঞ্ছনীয়।
ইন্দো-এরিয়ান অ্যান্ড হিন্দি বক্তৃতামালায় সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, নেশন হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে ভারতের একটি বড় বাধা বহুভাষিকতা। তাই হয়তো হিন্দিকে ভাষা থেকে ‘কভার টার্ম’-এ পরিণত করার মরণপণ চেষ্টা দেখা যায়। হিন্দিপন্থীদের যুক্তি, ভারতের ‘লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা’ ভারতীয় হওয়া উচিত। পাল্টা প্রশ্ন, দ্রাবিড়ীয়দের ‘লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা’ আর্যভাষা হবে কেন? উপরন্তু, ১৯৫৬-তে ভাষার ভিত্তিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ ক্ষমতাবণ্টন হয়েছিল। প্রশাসনকে হিন্দিকেন্দ্রিক করে তুললে ধরে নিতে হয়, ওই ভাগের সারবত্তা নেই।
সুতরাং আইন বলে ২২টি ভাষার সমান স্বীকৃতি। এবং রাজনীতি বলে, ১৯৬১-র ভাষাশুমারিতে ভারতে হিন্দিভাষীর শতাংশ ৩০, ২০১১-য় ৪৩। হিসেবের সঙ্গে মিলে যাবে দৈনন্দিন অভিজ্ঞতাও। বলিউডি ছবির এখন এমনই দাপট যে ‘সিনেমা দেখুন ও হিন্দি শিখুন’ গোছের বললেও ভুল হয় না। বহু বাঙালিই যে হিন্দিটা মোটামুটি জানেন-বোঝেন, তা এই ‘ক্র্যাশ কোর্স’-এর কারণেই। বলিউড যত বেড়েছে, বর্ধিত হয়েছে হিন্দির ক্ষেত্র।
ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক মহীদাস ভট্টাচার্যের মতে, সংখ্যাগুরু হিন্দির ভারে চাপা পড়েছে অাওয়াধি, ভোজপুরি, মারওয়াড়ির মতো লঘু স্বরেরা। তাদের সাহিত্য, ব্যাকরণে ধুলো জমে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ সবই আজ হিন্দির ছাতার তলায়। এক সময় হিন্দির অধীনে মাতৃভাষা বলে গণ্য হয়েছিল তারা। তার পর হিন্দির ক্ষমতা বেড়েছে, ক্ষয় ধরেছে তাদের। বহুভাষিক রাষ্ট্রে এটা সুস্থ গণতন্ত্র নয়, সেখানে সমমর্যাদাই কাম্য। দেশের শাসক একক সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজেপিও টিকে রয়েছে মাত্র ৩১ শতাংশ ভোটের উপরে। তবু হিন্দিতে খবর সম্প্রচারের ব্যবস্থা হয়েছে ত্রিপুরায়, যেখানে ককবরক আর হিন্দিভাষীর অনুপাত ২৬:২।
রাজ্যভিত্তিক ভাষা-আধিপত্যের মানচিত্রে দেখা যাবে, মোটামুটি এক একটি রাজ্য জুড়ে বিস্তৃত এক একটি ভাষা। শুধু অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে গিয়েছে হিন্দি— অন্তত দশটি রাজ্যে। অথচ ১৯৪০ সালে সুনীতিকুমার বলছেন: ‘‘কিছু নিরিখে ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাষা হিন্দি, যদিও তা বেশ কম সংখ্যক লোকেরই নিজের ভাষা।’’ হিন্দির আপন দেশ বলে চিহ্নিত করছেন তৎকালীন দক্ষিণ-পূর্ব পঞ্জাব, পশ্চিম সংযুক্ত প্রদেশ, উত্তর-পূর্ব কেন্দ্রীয় প্রদেশ, উত্তর গ্বালিয়র এবং পূর্ব রাজপুতানার একাংশ। এর মধ্যে আবার একটা বড় অংশ হল উপভাষার অঞ্চল। আজকের চেনা হিন্দি তখন মূলত শহরকেন্দ্রিক ছিল।
সুতরাং, পুরনো বিতর্ককে নতুন চালে বুঝতে হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও আগ্রাসী হয়ে জাঁকিয়ে বসবে ‘রাষ্ট্রভাষা’ হিন্দি। সেই বলে বলীয়ান হয়ে ‘একসূত্রে’ দেশ চালাবেন মোদী। সঙ্গতে বলিউড গাইবে ‘কাশ্মীর তু ম্যায় কন্যাকুমারী’।
ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।