প্রতীকী ছবি।
স্বাভাবিক’ কাহাকে বলে, তাহা স্থির করিবার নিষ্কণ্টক অধিকার সংখ্যাগরিষ্ঠের। অতএব, বেশির ভাগ মানুষ হইতে যাঁহারা কোনও একটি কারণে পৃথক, সংখ্যাগরিষ্ঠ তাঁহাদের নির্দ্বিধায় ‘অস্বাভাবিক’ বলিয়া দাগিয়া দিয়াছে। অটিজম-এর ন্যায় সমস্যায় আক্রান্ত মানুষরা, তাঁহাদের পরিজনরা, প্রতিনিয়ত সেই তকমাটির বিরুদ্ধে ল়ড়িতেছেন। স্কুল হইতে খেলার মাঠ, অথবা অন্য যে কোনও সামাজিক পরিসরে এই লড়াই লড়িয়া চলাকেই তাঁহারা ভবিতব্য বলিয়া জানেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে সচেতনতার অভাব, অবশ্যই। তাহার জন্য যেমন অশিক্ষা দায়ী, তেমনই অপরিচয়ের দায়ও কম নহে। ‘অপর’কে চিনিতে হইলে যে পরিসরটি প্রয়োজন, তাহার দরজায় পাগড়ি আঁটা দারোয়ান বসাইয়া রাখিলে অপরিচয়ের অন্ধকার ঘুচিবে কী ভাবে? একটি অপ্রত্যাশিত পরিসরে একটি দরজা খুলিল। একাধিক আন্তর্জাতিক কর্পোরেট সংস্থা অটিজম-আক্রান্ত মানুষদের চাকুরিতে নিয়োগ করিতেছে। নিখাদ পরার্থপরতা নহে— ওই মানুষদের এমন কিছু ক্ষমতা আছে, যাহা এই গোত্রের সংস্থার কাজের ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, অনেকের মধ্যে যুক্তিপরম্পরা বজায় রাখিয়া ভাবিতে পারিবার ক্ষমতা প্রখর। অনেকে সহজেই নির্দিষ্ট প্যাটার্ন বা ছক চিনিয়া লইতে পারেন। অনেকে খুঁটিনাটির দিকে দুর্দান্ত নজর রাখিতে পারেন। ‘নিউরো-টিপিকাল’ মানুষের তুলনায়, অর্থাৎ সমাজ যাঁহাদের ‘স্বাভাবিক’ বলিয়া চেনে, অটিজমে আক্রান্ত মানুষের এই দক্ষতাগুলি বেশি হইতে পারে। তেমন কর্মী নিয়োগ করা, উৎপাদনশীলতার যুক্তিতে, যথাযথ সিদ্ধান্ত।
কিন্তু, লাভ-লোকসানের অঙ্কের বাহিরেও কিছু বিবেচনা আছে। ‘নিউরো-টিপিকাল’ মানুষরা যাহাতে তাঁহাদের অটিজমে আক্রান্ত সহনাগরিকদের সহিত মিশিবার একটি পরিসর পান, এক সঙ্গে কাজ করিতে পারেন, তাহা নিশ্চিত করাও এই উদ্যোগের একটি লক্ষ্য। উদ্যোগটি এখনও সীমিত, কয়েকটি সংস্থায় সীমাবদ্ধ, কিন্তু তাহার তাৎপর্য বিপুল। মেলামেশার সুযোগ থাকিলেই বিভিন্ন ভ্রান্ত ধারণার বেড়া ভাঙে, মানুষ গ্রহণশীল হইয়া উঠে। কথাটি যে শুধু অটিজম আক্রান্ত মানুষের সহিত মেলামেশার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তাহা নহে। যেখানেই অপরিচয়ের বেড়া, সেখানেই ভ্রান্ত ধারণার বাস। মুসলমান প্রতিবেশীর সহিত মিশিতে আরম্ভ করিলে, ইদে-দুর্গাপূজায় পরস্পরের সান্নিধ্যে আসিলে যেমন বোঝা যায় যে ধর্মের ব্যবধানে মানুষ আলাদা হয় না, সমকামীদের সহিত বন্ধুত্ব করিতে পারিলে যেমন বিষমকামী মানুষ বুঝিতে শেখেন যে যৌনতাই একমাত্র পরিচয় নহে, কালো মানুষের কাছে আসিতে পারিলে সাদাদের মনের অন্ধকার যেমন কমে, অটিজমের ক্ষেত্রটিও তাহার ব্যতিক্রম নহে।
আজ কয়েকটি সংস্থার দরজা খুলিয়াছে। ভবিষ্যতে হয়তো আরও খুলিবে। কিন্তু, এখানেই থামিয়া থাকিলে চলিবে না। সংস্থাগুলির অভ্যন্তরে অটিজমে আক্রান্ত মানুষদের জন্য অনুকূল পরিবেশ যাহাতে তৈরি হয়, তাঁহাদের বিশেষ প্রয়োজনগুলির প্রতি নিয়োগকারীরা যাহাতে সর্বদা মনে রাখেন, তাহাও নিশ্চিত করিতে হইবে। শুধু কর্পোরেট ক্ষেত্র নহে, অন্যত্রও দরজা খুলিতে হইবে। ইহাও একটি অধিকারের লড়াই। স্বাভাবিক জীবনের অধিকার। ইতিহাস সাক্ষ্য দিবে, কোনও অধিকারই বিনা লড়াইয়ে অর্জিত হয় নাই। মহিলাদের ভোটাধিকার হইতে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য পৃথক শৌচাগার, সমকামী বিবাহের অধিকার হইতে কালো মানুষের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ বন্ধ করিবার লড়াই— প্রতিটি ক্ষেত্রেই তুমুল প্রতিরোধ পার হইয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করিতে হইয়াছে। সমাজ গোড়ায় মানিয়া লয় নাই। তাহাকে মানাইতে হইয়াছে। এই লড়াইয়ের মাধ্যমেই সভ্যতা অগ্রসর হইয়াছে। বর্তমান লড়াইটিও সেই ইতিহাসেরই অংশ।