বহিরঙ্গের জাঁকজমকে ভারতীয় দর্শনের মূল কথাটা হারিয়ে যাচ্ছে না তো?

আজ এই নেতি নেতি নেতি দেখতে দেখতে মনে হচ্ছে ‘নিবে আর দিবে’র সংস্কৃতি কোথায় গেল? লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০১৭ ০০:১৪
Share:

১৯২৭ সালের অগস্টে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বলিদ্বীপে যান সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। তখনকার একটি ঘটনা। পূর্ববলির ছোট একটি শহর, কারাঙ্–আসেম। সেখানকার নগরপাল এক বৈশ্যরাজার বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন, তাঁর সঙ্গী ছিলেন সুনীতিবাবু। সুনীতিবাবু লিখছেন, ওদের সঙ্গে আলোচনার জন্য তিনি এক আদর্শ হিন্দু ব্রাহ্মণের মতো সঙ্গে পুজোর তৈজসপত্র ও অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে যান। আবার নিজের সুবিধের জন্য সঙ্গে একখানি পুরোহিত দর্পণও নিয়ে যান তিনি। রাজা পারস্পরিক আলোচনার জন্য ব্রাহ্মণ-পুরোহিতদের ডেকে পাঠান। দোভাষী ছিল। রাজার ভাষা মালাই, কিন্ত তাঁরা ভারতের হিন্দু মন্দিরগুলি সম্পর্কে সবিস্তার সব শুনলেন। কারাঙ্–আসেমের সে রাজাও পণ্ডিত। মালাই ভাষায় প্রকাশিত তাঁর বই বলিদ্বীপে প্রচলিত হিন্দুধর্মের স্বরূপ তাতে বর্ণনা করেছেন। সারা দিন কাটানোর পর এক দিঘির ধারে এই উঁচু ঘরে বসে রাজা সুনীতিবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন, দেবতা, শ্রাদ্ধ, দেবার্চনা, হিন্দু সামাজিক রীতি, এ সব তো অনেক শুনলাম। অনেক কথা হল। কিন্তু এখন বলুন তো মানুষের জীবনের চরম লক্ষ্য কী? প্রশ্নটি রাজা খুব আন্তরিক ভাবেই করেন। সুনীতিবাবু বলছেন, আমি তাঁকেই পাল্টা প্রশ্ন করলাম, আগে আপনি বলুন আপনার মত কী? জবাবে নাকি রাজা বলেন, ‘ডেওআ-ডেওআ টিডাঃ আপা, নিরওয়ানা সাটু’। অর্থাৎ, এ সব দেবদেবী-মন্দির–আচার-বিচার— এ সব কোনও কাজের নয়। আসল হল নির্বাণ। রবীন্দ্রনাথও প্রথমে ভেবেছিলেন, এরা মালাই জাতির লোক। চিন্তাভাবনায় আমাদের থেকে আলাদা। ভারতীয় সভ্যতার বহিরঙ্গের জাঁকজমক দেখে প্রথমে ওরা আকৃষ্ট হয়, পুরাণ কথায় মুগ্ধ হয়। কিন্তু রাজার কথা শুনে রবীন্দ্রনাথেরও মনে হয় ভারতের প্রকৃত আধ্যাত্মিক বাণী ওরাও ঠিকমতো ধরতে পেরেছে।

Advertisement

সুনীতিবাবু এ সব গপ্পো প্রবাসী পত্রিকায় তখন ধারাবাহিক ভাবে লেখেন যা পরে দ্বীপময় ভারত নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। আজ এত বছর পর সুনীতিবাবুর বইটি আবার পড়তে পড়তে মনে হচ্ছে, আমাদের দেশেও হিন্দু জাতীয়তাবাদ, হিন্দু সংস্কৃতি নিয়ে যে ‘বহিরঙ্গের জাঁকজমক’ দেখছি তা কি যথার্থ ভারতীয় দর্শনের মূল আধ্যাত্মিক বাণী? ভারত কি সেই বাণীকে আবার কার্যকর করতে পারবে যাতে সে তার পূর্ব রীতিতে বিশ্বমানবের কল্যাণ-মিত্র রূপে জীবনে শ্রেয়র সন্ধানে সহায়ক হয়ে বিশ্বমানবের সেবা করে আবার ধন্য হতে পারবে?

সুনীতিবাবু কিন্তু বলে গেছেন নানা জাতির সংমিশ্রণের ফলে আমাদের হিন্দুজাতি। এই সংমিশ্রণ প্রাচীনকালে অতি সহজেই অনুলোম-প্রতিলোম বিবাহের দ্বারা হয়েছিল। তারপর তুর্কি বিজয়ের পর থেকে জাতিভেদের কড়াকড়ি এসে গেল। বন্য অবস্থা থেকে শুরু করে বর্বর অবস্থার মধ্য দিয়ে সভ্যতার উত্তরণের ধারায় মানব প্রকৃতির ওপর গবেষণা করেন লুইস হেনরি মর্গান। মর্গানের গবেষণার প্রথম সিদ্ধান্ত ছিল, মানব সমাজে এককালে দলগত বিবাহ, অর্থাৎ অবাধ যৌনসংসর্গ ছিল। সেই অবাধ যৌনাচার থেকে পরে পৃথক পৃথক গোষ্ঠী তৈরি হয়। মানুষের এই ইতিহাস চিত্তাকর্ষক। এই ইতিহাসের প্রেক্ষিতে ভারতীয় সমাজের আর্য-অনার্য গোষ্ঠীর স্বকীয়তা ও সংমিশ্রণের দ্বান্দ্বিকতা বুঝতে অসুবিধা হয় না।

Advertisement

আজ এই নেতি নেতি নেতি দেখতে দেখতে মনে হচ্ছে ‘নিবে আর দিবে’র সংস্কৃতি কোথায় গেল? রাহুল সাংকৃত্যায়নের জীবন নিয়ে সম্প্রতি একটা নতুন বই বাজারে এসেছে। Alka Atreya Chudal লিখছেন A free thnking Cultural Nationalist- A life history of Rahul Sankrityayan. লেখিকা ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। অলকা দেখিয়েছেন, এক বৈষ্ণব সাধু কী ভাবে আর্যসমাজী হন, তা থেকে তিনি হন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, হিন্দি জাতীয়তাবাদী এবং সবশেষে কমিউনিস্ট। এ হেন রাহুলের জীবন থেকে বোঝা যায় তিনি কিন্তু ভারতীয় সংস্কৃতির মূল ধারাকে ভুলে যেতে চাননি। যা এ দেশের বহু কমিউনিস্টই করেছেন। নরেন্দ্র মোদী আর অমিত শাহের যুগে রবীন্দ্রনাথের বর্ণিত ভারতের মোহ-মোচন বাণীকেই আমরা ভুলতে বসেছি। ভারত এক অখণ্ড মানব-প্রচেষ্টার অংশ। প্রাকবৈদিক মহেঞ্জোদারোর সংস্কৃতিও যে বৈদিক যোগ আর হোমে প্রভাব ফেলেছিল সে কথা সুনীতিবাবুও বার বার বলছেন, বলছেন রাহুল সাংকৃত্যায়ন।

তা হলে খামোখা হিটলারের মতো হিন্দু ‘রেস’-এর বিশুদ্ধতা নিয়ে শিরা ফুলিয়ে একদেশদর্শী চিৎকারে লাভ কী?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন