প্যান্ডোরার ঝাঁপি

এ দেশের সংরক্ষণ নীতির ইতিহাসে নূতন অধ্যায় যোগ করিল মহারাষ্ট্র।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

মরাঠা ক্রান্তি মঞ্চের বিক্ষোভ। অওরঙ্গাবাদে।ফাইল চিত্র।

এ দেশের সংরক্ষণ নীতির ইতিহাসে নূতন অধ্যায় যোগ করিল মহারাষ্ট্র। রাজ্য মন্ত্রিসভা সরকারি চাকুরিতে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মরাঠাদের জন্য সংরক্ষণ প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত অনুমোদন করিল। সংরক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট নূতন বর্গটির নাম: সামাজিক ও শিক্ষাগত ভাবে পশ্চাৎপদ গোষ্ঠী (সোশ্যালি অ্যান্ড এডুকেশনালি ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস)। মহারাষ্ট্রে মরাঠাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্যে বা সামাজিক মর্যাদায় পশ্চাৎপদ বলিবার উপায় নাই। তাহা সত্ত্বেও মরাঠা সংরক্ষণের দাবিতে রাজ্য উত্তাল হইয়া উঠে, মরাঠা আন্দোলন জনজীবনকে প্রায় স্তব্ধ করিয়া দেয়। যুক্তি: ক্ষত্রিয় গোষ্ঠীভুক্ত, ঐতিহ্যগত ভাবে সামাজিক উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত মরাঠাদের মধ্যে অসমতা যথেষ্ট, এবং তাঁহাদের এক বড় অংশ মনে করেন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে তাঁহারা অন্যদের— প্রধানত সংরক্ষণভোগী অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি (ওবিসি)— অপেক্ষা পিছাইয়া পড়িতেছেন। বাস্তবিক, এই মরাঠা আন্দোলনটি তৈরি হইবার পিছনে তাঁহাদের সহিত ওবিসি-র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সংঘর্ষের ভূমিকা বিরাট— আন্দোলনের উৎস ছিল তুলনায় অনুন্নত ‘পকেট’গুলি, যেখানে কৃষি সঙ্কটের সঙ্গে পাল্লা দিয়া বাড়িয়াছে চাকুরির সঙ্কোচন ও তজ্জনিত ক্ষোভ। গুজরাতের পতিদার গোষ্ঠীর মতো মহারাষ্ট্রের মরাঠারাও তাই এক ভিন্ন অর্থে ‘পশ্চাৎপদ গোষ্ঠী’ বলিয়া নিজেদের প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর ছিলেন।

Advertisement

সংরক্ষণের জন্য আলাদা ও নূতন ধারা তৈরির দরকার পড়িল কেন, তাহাও এই সূত্রেই বোঝা যাইবে। যাহাতে এই মুহূর্তে সে রাজ্যের সংরক্ষণপ্রাপক ৫২ শতাংশ জনতার সহিত কোনও ভাবে ভাগাভাগি না করিতে হয়, যাহাতে ১৩ শতাংশ তফশিলি জাতি, ১৭ শতাংশ তফশিলি জনজাতি, ১৯ শতাংশ ওবিসি এবং অন্যদের অপেক্ষা নিজেদের সংরক্ষণের প্রাপ্যকে সম্পূর্ণ পৃথক রাখা যায়, তাহাই নিশ্চিত হইল এই নূতন ধারার উদ্ভাবনে। মরাঠারা ১৬ শতাংশ সংরক্ষণ চাহিলেও কতটা শেষ পর্যন্ত প্রদত্ত হইবে, তাহা এখনও খানিকটা অস্পষ্ট। কিন্তু রাজ্যের অবস্থাপন্ন সম্প্রদায়কে সংরক্ষণের আওতায় আনিবার এই প্রকল্পে প্রথম সাফল্য অর্জনের জন্য মহারাষ্ট্র ইতিহাস রচনা করিল। একটি প্রশ্ন উঠিবেই। সুপ্রিম কোর্টের নিদান অনুসারে ভারতের সংরক্ষণকে ৫০ শতাংশের মধ্যে বাঁধিয়া রাখিবার কথা। মহারাষ্ট্রে বর্তমানে ৫২ শতাংশ সংরক্ষণ চালু। মরাঠাদের সংরক্ষণের সূচনা হইলে তাহা আরও অনেক দূর উঠিয়া যাইবে। কিন্তু মহারাষ্ট্র এই দুশ্চিন্তার নিরসন হিসাবে তামিলনাড়ুকে দেখাইয়া দিবে— ভারতের মধ্যে সর্বোচ্চ সংরক্ষণ যে রাজ্যে, যাহার ঠিক পরই ছিল মহারাষ্ট্র। মরাঠাদেরই বা এই যু্ক্তিতে ঠেকাইয়া রাখা হইবে কেন, সেই প্রশ্ন বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীস ইতিমধ্যেই তুলিয়াছেন।

তাঁহার প্রধান বিরোধীরাও এই প্রশ্নে ভিন্নমত প্রকাশ করিতে পারিবেন না— রাজ্যের ৩১ শতাংশ যে গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, রাজনীতিতে তাহাদের চটানো বুদ্ধির পরিচায়ক নহে। ভারতের মতো ক্ষুদ্রস্বার্থ সংবলিত বৃহৎ গণতন্ত্রে যে শেষ পর্যন্ত সমাজনীতি এবং অর্থনীতি একমাত্র এবং কেবলমাত্র রাজনীতির অঙ্গুলিহেলনে চলে, মরাঠা সংরক্ষণ তাহারই অভ্রান্ত দিগ্‌দর্শক। এবং তাহাই গভীরতর দুশ্চিন্তার কারণ। এ দেশে সংরক্ষণ ক্রমশই, বিশেষত মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ লইয়া বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের পর, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার এক হাতিয়ার হইয়া উঠিয়াছে। গত কয়েক বছরে সেই ইতিহাসে নূতন মাত্রা যোগ করিয়াছে জাঠ, পতিদার ও মরাঠিদের সংরক্ষণের দাবি। এই দাবি ধ্রুপদী সংরক্ষণ নীতির প্রতিক্রিয়ায় উচ্চতর বর্গের স্বার্থসন্ধানী অভিযান, যাহা চরিত্রে ষোলো আনা রাজনৈতিক। মহারাষ্ট্রে এই অভিযানের সাফল্য অন্য নানা অঞ্চলেও নূতন আলোড়ন তুলিবে, এমন আশঙ্কা অস্বাভাবিক নহে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন