বারোদোলের সঙ্গে জুড়ে আছে অনেক গল্প

সে সময়কার অর্থনীতিতে এই মেলার গুরুত্ব ছিল। তখন বাজার এত উন্নত ছিল না। সকলে মেলাটিকে কাজে লাগাতেন উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রির জন্য। লিখছেন দেবযানী ভৌমিক চক্রবর্তীবারোদোল কথাটির বিশ্লেষণে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নবম উত্তরপুরুষ সৌমীশচন্দ্র রায় বলেন ‘‘বারোদোল আসলে বারো ঠাকুরের দোলের খেলা।’’

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৯ ০১:১২
Share:

বারোদোল মেলার সঙ্গে একটা ধর্মীয় ঐতিহ্য জুড়ে থাকলেও এর মূলে রয়েছে রাজ-অন্দরমহলের বিশেষ কাহিনি।

বাঙালি উৎসবপ্রিয় জাতি। বাংলার পরম্পরা লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে প্রাচীনে শুরু হওয়া উৎসবগুলি প্রায় সবই বজায় আছে, বরং আরও কিছু যুক্ত হয়েছে। সেরকমই একটি দোলোৎসব। যদিও দোল বা হোলি সর্বভারতীয় উৎসবে পরিণত। এই দোলোৎসবের পরে দ্বিতীয় একাদশী তিথিতে নদিয়ার কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির প্রাঙ্গণ জুড়ে বসে বারোদোলের মেলা। জেলার মানুষের মধ্যে এই মেলাকে কেন্দ্র করে উৎসাহ-উদ্দীপনা অন্তহীন। আসলে মেলার তো একটা মানবিক আবেদন থাকেই। মানুষের মধ্যে পারস্পরিক মেলবন্ধন এতে দৃঢ় হয়। নানা ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষ আনন্দে মাতেন এই মেলায়। মূলত বারোদোলের প্রাণশক্তি হল অসাম্প্রদায়িক মানবাদর্শ।

Advertisement

রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন প্রবল ভাবেই সংস্কৃতিমনস্ক। তাঁর বসতভূমি কৃষ্ণনগর। বর্তমানে নদিয়া জেলার আয়তন ৩,৯২৭ বর্গকিমি। নদিয়ার রাজধানী তথা সদর শহর কৃষ্ণনগর। কথিত আছে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নামে কৃষ্ণনগর। আর একটি মত হল, রামকৃষ্ণ রায়ের পুত্র রাঘব রায়, আর তাঁর পুত্র রুদ্র রায়, যিনি ছিলেন পরম কৃষ্ণভক্ত। তিনিই নাকি শ্রীকৃষ্ণের নামানুসারে পূর্বের রেউই নাম পরিবর্তন করে রাখলেন কৃষ্ণনগর। নদিয়ারাজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ভবানন্দ মজুমদার। যাঁর উল্লেখ রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে আছে। তাঁর পৌত্র রাজা রাঘব রায় তাঁর জমিদারিভুক্ত অঞ্চলের মাঝামাঝি স্থানে, জলঙ্গি নদীতীরে রেউই গ্রামের চারদিকে পরিখা খনন করে রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। পরে রাঘবের পুত্র রুদ্র রায় এই নাম পরিবর্তন করে রাখেন কৃষ্ণনগর। রাজা রুদ্র দিল্লির বাদশাহ জাহাঙ্গিরের থেকে পূর্তকাজে দক্ষ স্থপতি আনিয়ে কৃষ্ণনগর কাছারি, চক, চারমিনারের মতো তোরণ নির্মাণ করেন। রুদ্র রায়ের পুত্র রঘুরাম ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্রের পিতা। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রই (১৭১০-১৭৮৩) ছিলেন এই বারোদোল মেলার প্রতিষ্ঠাতা।

বারোদোল মেলার সঙ্গে একটা ধর্মীয় ঐতিহ্য জুড়ে থাকলেও এর মূলে রয়েছে রাজ-অন্দরমহলের বিশেষ কাহিনি। কৃষ্ণচন্দ্রের ছোটপত্নী অর্থাৎ তাঁর আদরের ছোটন আবদার করেছিলেন তাঁকে উলায় মেলা দেখাতে নিয়ে যেতে হবে। রাজা প্রতিশ্রুতও হয়েছিলেন। কিন্তু কর্মব্যস্ততায় তা তিনি সম্পূর্ণ ভুলে যান। এতে ছোটরানির তো বেজায় অভিমান হয়। রাজাও রানির সন্তুষ্টিবিধানের জন্য সচেষ্ট হলেন। উলায় মেলা দেখাতে নিয়ে যেতে পারেননি। তাই মনস্থ করেন রাজবাড়িতেই মেলা বসাবেন। তাঁর রাজসভার পণ্ডিতদের কাছে তিনি বিধান চাইলেন মেলা বসানোর ভাল সময় সংক্রান্ত বিষয়ে। জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন-সহ অন্য পণ্ডিতগণ পরামর্শ দিলেন চৈত্রমাসের শুক্লা একাদশী তিথিতে নৃত্য-গীত-সহ দেবদেবীকে দক্ষিণমুখে দোলায় বসিয়ে দোলালে শুভফল লাভ হয়। যা হরিভক্তিবিলাস তথা গরুড় পুরাণে রয়েছে।

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

বারোদোল কথাটির বিশ্লেষণে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নবম উত্তরপুরুষ সৌমীশচন্দ্র রায় বলেন ‘‘বারোদোল আসলে বারো ঠাকুরের দোলের খেলা।’’ আমরা এ ভাবেও ভাবতে পারি, এটি আসলে দেবতাদের মিলনোৎসব। কাজেই, তাকে কেন্দ্র করে ভক্তজন বা সাধারণ মানুষের জন্য মেলার আয়োজন তো স্বাভাবিক। বারোটি বিগ্রহকে নদিয়ার বিভিন্ন স্থান থেকে আনার প্রচলন রয়েছে। বিগ্রহগুলি রাজা কৃষ্ণচন্দ্রই বিরহী, বহির্গাছি, তেহট্ট, সুত্রাগড়, নবদ্বীপ, শান্তিপুর ইত্যাদি স্থানে মন্দির নির্মাণ করে স্থাপন করেছিলেন৷ তাঁরই প্রবর্তিত দেবোত্তর সম্পত্তিতে সারা বছর পূজার্চনার রীতি। সেই বিগ্রহগুলিকেই মহা সমারোহে বারোদোলের সময় এনে তিন দিনের জন্য ভক্তদের দর্শনের সুযোগ করে দেওয়া হয়। তিন দিনে দেবতাদের তিন রকম সজ্জা। প্রথম দিন রাজবেশ, দ্বিতীয় দিন ফুলবেশ আর তৃতীয় দিন রাখালবেশ।

কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির পঙ্খের কাজ করা সুবিশাল ঠাকুর দালানের দক্ষিণ দিকে চাঁদনি। সেখানেই বারোদোলের মূল মঞ্চ। নদিয়ারাজের কুলবিগ্রহ হলেন বড় নারায়ণচন্দ্র। তাঁর সঙ্গেই মিলিত হতে আসেন বলরাম, গোপীমোহন, লক্ষ্মীকান্ত, ছোট নারায়ণচন্দ্র, গোবিন্দদেব, কৃষ্ণচন্দ্র, নদের গোপাল, গড়ের গোপাল, গোষ্ঠবিহারী, মদনগোপাল, গোপীনাথ ও কৃষ্ণ রায়।

তেহট্টের কৃষ্ণ রায়কে অবশ্য অনেক দিন থেকেই আর মন্দির কর্তৃপক্ষ পাঠাচ্ছেন না। আর অগ্রদ্বীপের গোপীনাথও কয়েক বছর ধরেই আর আসছেন না। ভক্তরা তাঁর দর্শনলাভে বঞ্চিত হচ্ছেন। যদিও মানুষের বিশ্বাস, গোপীনাথের কৃপা তাঁদের সঙ্গে সর্বদা রয়েছে। বিগ্রহগুলিকে কাঠের সিংহাসনে বসিয়ে দোল দেওয়া হয়। ভক্তগণ দেবতাদের চরণে আবির দেন, বাড়ির গাছের প্রথম ফল নিবেদন করেন। ঐতিহাসিক সূত্র বলছে বারোদোলের সূচনা ১৭৬৪ সালে। যদিও শ্রদ্ধেয় সৌমীশচন্দ্রের কথায় ১৭৪৪-এ বারোদোলের সূচনা ১৯১০-এ প্রকাশিত ‘দ্য বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার’-এ জেএইচই গ্যারেট বলেছেন— বারোদোলে ২০,০০০ ভক্ত সমাগম হত।

এর থেকেই আমরা অনুমান করতে পারি, এখন এই বিপুল জনসংখ্যার যুগে এই সংখ্যাটি আরও কত হবে। সৌমীশবাবুর পুত্র অর্থাৎ রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দশম পুরুষ মণীশচন্দ্র রায় বললেন, ‘‘অন্যত্র থাকলেও এই সময় আমরা শিকড়ের টানেই আসতে চাই।’’

সম্প্রদায়গত ভেদের ঊর্ধ্বে এই বারোদোলের মেলা। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন শক্তির উপাসক। কিন্তু বারোদোলে পূজিত হন কৃষ্ণ বা নারায়ণের বিগ্রহ। অর্থাৎ তিনি শাক্ত হয়েও বৈষ্ণব মতকে এখানে প্রাধান্য দিলেন। এ ভাবেও ভাবা যায়, শাক্ত ও বৈষ্ণব ধর্মের তিনি মেলবন্ধন ঘটালেন এখানে। শাক্ত হল সহনশীলতা তথা ঐশ্বর্যের প্রতীক। আর বৈষ্ণব ধর্ম হল প্রেমের প্রতীক। স্ত্রীয়ের প্রতি আন্তরিক ভালবাসাই এই মেলার জন্ম দিয়েছে। কাজেই, ঐশ্বর্য এখানে ভালবাসাকে আশ্রয় করেছে। বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীও এই মেলায় অংশ নেন, যা এই মেলার একটা সদর্থক দিক।

সে সময়কার সমাজ ও অর্থনীতিতেও এই মেলার একটা গুরুত্ব ছিল। তখন বাজার এত উন্নত ছিল না। সকলে মেলাটিকেই কাজে লাগাতেন তাঁদের উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রির জন্য। বর্তমানে মেলার বৈচিত্র আরও বেড়েছে। বিভিন্ন শপিং মলের এক-একটি সংস্করণ দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। এছাড়া ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের পোশাক বা গয়না তো আছেই। শুধু ভারতই নয়, বাংলাদেশের শাড়ি বিক্রেতাদেরও দেখা মেলে।

পাওয়া যায় কাঠের আসবাব থেকে শুরু করে কাঁসা, পিতল, স্টিল তথা পাথরের বাসন। নানান প্রাদেশিক খাদ্যের তো তুলনাই নেই। বিদেশি খাবারের স্টলও থাকে। শিশুদের কাছে মেলার মূল আকর্ষণ হল সার্কাস। যদিও এখন সতর্কতার কারণে অনেক পশুর খেলাই নিষিদ্ধ। সব মিলিয়ে নদিয়ার ঐতিহ্য এই বারোদোল মেলা নদিয়ার গর্ব।

লেখক শ্রীপৎ সিং কলেজের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন