ভারতের শিকার-মানচিত্রে কোচবিহারের মহারাজারা

শিকারের কাল গিয়েছে। শুধু থেকে গিয়েছে রাজকীয় মৃগয়ার ইতিহাস। সে ইতিহাসে উজ্জ্বল নাম কোচবিহারের রাজপরিবারের। লিখছেন সুবীর সরকারব্রিটিশ ঐতিহাসিক ক্যাম্বেলের বর্ণনায় মহারাজা নরেন্দ্রনারায়ণ ও নৃপেন্দ্রনারায়ণের শিকারযাত্রার চমৎকার বর্ণনা মেলে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৮ ০২:০০
Share:

কোচবিহারের কোচ রাজারা ছিলেন শিকারে বিশেষ পারদর্শী। ভারতের শিকার-ইতিহাসে কোচবিহার মহারাজদের নাম স্মরণীয়। মহারাজা প্রাণনারায়ণ, ধৈর্যেন্দ্রনারায়ণ, রূপনারায়ণের মুদ্রায় শিকারদৃশ্য অঙ্কিত দেখা যায়।

Advertisement

ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ক্যাম্বেলের বর্ণনায় মহারাজা নরেন্দ্রনারায়ণ ও নৃপেন্দ্রনারায়ণের শিকারযাত্রার চমৎকার বর্ণনা মেলে। উত্তর পূর্বাঞ্চলের ব্রিটিশ রেসিডেন্ট লর্ড জেঙ্কিংসের বিভিন্ন চিঠিপত্রে কোচ রাজাদের শিকার পারদর্শিতার কথা জানা যায়। জলপাইগুড়ির রায়কতদের পারিবারিক ‘দিনলিপি’ থেকে জানা যায়— ‘বহু গণ্যমান্য দেশীয় ব্যক্তি ও ব্রিটিশ অতিথিবৃন্দ পরিবৃত হইয়া হস্তী, অশ্ব, কাড়া-নাকাড়া, চাকরবাকর, সেনা, অস্ত্র ও বিপুল রসদপত্র সমভিব্যহারে কুচবিহারের ভূপবাহাদুর চলিলেন ঘন জঙ্গল অভিমুখে জমকালো শিকারযাত্রায়’।

মহারাজা বিশ্বসিংহের শিকার অভিযান সম্পর্কে কিছুই প্রায় জানা যায় না। তবে, মহারাজা নরনারায়ণ ও তাঁর ভাই বীর যোদ্ধা চিলারায়ের বহুবর্ণ শিকার কাহিনির কথা আমরা জানতে পারি ‘অসম বুরুঞ্জী’ থেকে। পাঙ্গা, গোয়ালপাড়া, জয়ন্তীয়া, খাসি পাহাড়ের ঘন ও দুর্গম অরণ্যে তাঁরা নিয়মিত শিকারে যেতেন। জয়ন্তী, কাছাড়, বিজনী রাজদরবারের পুরনো নথি থেকে কোচ রাজা বীরনারায়ণ, মোদনারায়ণ, ধরেন্দ্রনারায়ণের শিকার দক্ষতার কথা জানা যায়।

Advertisement

নেপালের কাঠমান্ডুতে রাজপ্রাসাদ সংলগ্ন বিষ্ণুমন্দিরের শিলপাটায় খোদিত বর্ণনা থেকে জানা যায়, নেপালরাজ প্রতাপমল্লের আমন্ত্রণে বেশ কয়েকবার কোচবিহাররাজ প্রাণনারায়ণ নেপাল গিয়েছিলেন শিকারে অংশ নিতে। মহারাজ প্রাণনারায়ণের বোন রূপমতীও ছিলেন শিকারে দক্ষ। রূপমতী অসি ও অশ্বচালনায় পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন।

পরবর্তী কালে রানি বৃন্দেশ্বরী দেবী, নিস্তারিণী দেবী, সুনীতি দেবী (কেশবচন্দ্র সেনের কন্যা), ইন্দিরা দেবী, নিরুপমা দেবী (কবি ও ‘পরিচারিকা পত্রিকা’র সম্পাদক), মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণের স্ত্রী জর্জিনা (জিনা নারায়ণ) প্রমুখেরাও শিকারে পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন।

রাজকুমার হিতেন্দ্রনারায়ণ, ইন্দ্রজিতেন্দ্রনারায়ণ, রাজকুমারী ইলা দেবী, গায়ত্রী দেবী (জয়পুরের রাজমাতা) অশ্ব, অসি ও বন্দুক চালনায় নিপুণ ছিলেন।

উনবিংশ শতকের রেনেসাঁস ও সংস্কার আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ল দেশীয় রাজ্য কোচবিহারেও। সেই সময় কোচ সিংহাসনে আসীন মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ। তিনি ছিলেন আধুনিক, রুচিবান, কৃতবিদ্য মানুষ এবং আধুনিক কোচবিহারের জনক। মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণকে বলা হয় তৎকালীন উত্তর-পূর্ব ভারতের শ্রেষ্ঠ নৃপতি। মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ ইংল্যান্ডে বাল্যশিক্ষা ও সমরশিক্ষা গ্রহণ করেন। রানি ভিক্টোরিয়ার বিশেষ স্নেহভাজন ছিলেন তিনি। ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনের পুরোধা কেশবচন্দ্র সেনের কন্যা সুনীতি দেবীকে তিনি বিয়ে করেছিলেন।

মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ ছিলেন ভারতের অন্যতম দক্ষ শিকারি। নিজে ভাল ঘোড়া চালাতে পারতেন। তাঁর নিজস্ব অস্ত্রাগারে ৩৭ রকমের দেশি ও বিদেশি বন্দুক ছিল। ভারতের শিকার-মানচিত্রে ছোট্ট দেশীয় রাজ্য কোচবিহারকে তিনি দাঁড় করিয়েছিলেন বিশেষ মর্যাদার আসনে। পাতলাখাওয়া, চিলাপাতা, টাকোয়ামারির ঘন শাল-সেগুন গাছে পরিপুর্ণ এবং উঁচু ঘাসের আদিম, রহস্যময় বনভূমি ছিল মহারাজাদের ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চল’। ১৮৭১ থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৭ বছর মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ ডুয়ার্স ও অসমের জঙ্গলে নিয়মিত শিকার করেছেন। সেই শিকারের খুঁটিনাটি লিখে রাখতেন তিনি ডায়েরিতে। সেই ডায়েরি ১৯১১ সালে বই আকারে প্রকাশিত হয়। মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের সেই দুষ্প্রাপ্য শিকারগ্রন্থের নাম ‘থার্টি সেভেন ইয়ার্স অব বিগ গেম হান্টিং গল কোচবিহার, ডুয়ার্স অ্যান্ড অসম’। মোট ২৯টি অধ্যায়ে বিভক্ত ৪৬১ পাতার এই বইটি চিত্তাকর্ষক ভঙ্গিতে লেখা। রয়েছে ৩৮টি পুরনো মানচিত্র, ১৫৯টি বিরল ছবি। এই মূল্যবান বইটির আবারও জরুরি আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার জন্য।

বহু ব্রিটিশ রাজপুরুষ, অন্য রাজ্যের রাজা-মহারাজারা নৃপেন্দ্রনারায়ণের আমন্ত্রণে বহুবার শিকারযাত্রায় শামিল হয়েছিলেন। যেমন, বর্ধমানের মহারাজা বিজয়চাঁদ মহতাব, গৌরীপুরের রাজা প্রভাতচন্দ্র বড়ুয়া (প্রমথেশ বড়ুয়ার পিতা), মহিষাদল, কেওনঝড়, মানভূম, পাতিয়ালা, বরোদা, প্রতাপগড়, তমলুক প্রভৃতি স্থানের রাজা-মহারাজারা কোচবিহারে শিকারে অংশ নিতেন।

লর্ড কার্জন ১৯০৪ সালে জলদাপাড়ায় এসেছিলেন কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের আমন্ত্রণে। সেবার কার্জন তিনটি চিতাবাঘ শিকার করেছিলেন। কোচবিহার রাজ্যের ব্রিটিশ প্রশাসক ক্যাম্বেলের লেখায় আমরা কোচবিহার রাজাদের বর্ণাঢ্য শিকারযাত্রার বিবরণ পাই।

কোচবিহারের সর্বশেষ মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্রনারায়ণ ভূপবাহাদুর ছিলেন শিকার ও খেলাধুলোয় সমান পারদর্শী। ইংল্যান্ডের রানির সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্রনারায়ণ রঞ্জি ট্রফিতে একবার বাংলা ক্রিকেট দলের অধিনায়কত্ব করেছিলেন। ভারতীয় পোলো দলেও খেলেছিলেন তিনি। জগদ্দীপেন্দ্রনারায়ণ হলিউডের ‘দ্য হান্টার’ তথ্যচিত্রে অভিনয় করেছিলেন, যার আংশিক চিত্রগ্রহণ কোচবিহারের শুটিং ক্যাম্প ও পাতলাখাওয়ার জঙ্গলে হয়েছিল। পাতলাখাওয়ার জঙ্গলে অনেকবার তিনি বিদেশি ও দেশীয় অতিথিদের নিয়ে শিকার করেছেন। গৌরীপুরের রাজা প্রভাত বড়ুয়া, রাজকুমার প্রকৃতিশচন্দ্র (লালজি), জলপাইগুড়ির রাজা প্রসন্নদেব রায়কত, রানি অশ্রুমতী প্রায়ই আসতেন মহারাজার শিকারসঙ্গী হতে। মহারাজাদের শিকারের সঙ্গে ‘রাজার দীঘি’ ও ‘শুটিং ক্যাম্প’ নাম দু’টি স্মরণীয় হয়ে আছে।

১৯৬৭ সালের সেপ্টেম্বরে শেষবারের মতো মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্রনারায়ণ পত্নী জিনা নারায়ণকে নিয়ে পাতলাখাওয়ার জঙ্গলে শিকারে এসেছিলেন। অঞ্চলের প্রচীন মানুষজনের স্মৃতিতে যা আজও অমলিন। সেবার তিনি দু’টি বাঘ ও ১১টি হরিণ শিকার করেছিলেন বলে শোনা যায়।

রাজতন্ত্র নেই। হাতিশালা-ঘোড়াশালা সব উধাও। কোচবিহার এখন একটি সীমান্ত জেলা। বন্যপ্রাণী নিয়ন্ত্রণ আইনের সুবাদে শিকার বহু কাল নিষিদ্ধ। শিকার সমর্থনীয়ও নয়। মানুষের লোভ, নগরায়ণ আর জনবিষ্ফোরণের কারণে অরণ্যও এখন তীব্র কোণঠাসা। ঐতিহ্যবাহী, বহুবিচিত্র ‘কামতা-কোচ’ রাজাদের শাসনকাল আজ কেবলই স্মৃতি। তীব্র উদাসীনতা নিয়েই সময় বয়ে চলে। তবুও দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শিকার-মানচিত্রে কোচবিহারের মহারাজাদের কাহিনি আজও ধরে রেখেছে সেকালের একখণ্ড সময়কে।

(লেখক মাথাভাঙার প্রেমের ডাঙা হাইস্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত। উদ্ধৃতির বানান, যতি অপরিবর্তিত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন