নাথুরামের প্রত্যাবর্তন
Editorial Opinion

‘আপ ক্রোনোলজি সমঝিয়ে’

গাঁধীর মৃত্যুদিনে ফের উগ্র দেশপ্রেমের নামে প্রতিবাদ মিছিলে ছাত্রের উপরে চলল গুলি। গাঁধী-ঘাতক নাথুরাম গডসের মতো ওই বন্দুকবাজকেও সাচ্চা দেশপ্রেমিক ঘোষণা করল হিন্দু মহাসভা। এই সেই প্রতিষ্ঠান, যারা স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল। পাশে ছিল ব্রিটিশদের। ইতিহাস-নির্ভর তথ্য খুঁজল আনন্দবাজারগাঁধী পরিচালিত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে হিন্দু মহাসভা ছিল ব্রিটিশদের পক্ষে।

Advertisement

সায়ন্তন দাস

শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৩:০০
Share:

জামিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদী ছাত্রদের সামনে হঠাৎই বন্দুক হাতে হাজির হয় এক যুবক। স্লোগান তোলে— ‘এই নাও স্বাধীনতা’।

১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি। গাঁধীর শেষযাত্রা শুরু হল। মাত্র ৬০০ ফুটের যাত্রা। অন্য দিনের তুলনায় একটু ধীর পদক্ষেপে হাঁটছেন। গন্তব্য প্রার্থনা সভা। এমন সময়ে ভিড় ঠেলে সামনে হাজির খাকি পোশাকের নাথুরাম গডসে। চকিতে তিনটে গুলি। দু’টো বুকে, একটি তলপেটে। গাঁধীজির সাদা শাল লাল রক্তে মুহূর্তে ভরে গেল। দু’টো হাত তখনও তাঁর প্রণামের ভঙ্গিতে জোড়া। শেষ বাক্য উচ্চারণ করলেন— ‘হে রাম’। অহিংসার সাধনার এর চেয়ে আর কী নাটকীয় পরিসমাপ্তি হতে পারত?

Advertisement

কে এই নাথুরাম গডসে? সহজ উত্তর— হিন্দু মহাসভার একনিষ্ঠ এক সদস্য। যাঁর রাজনৈতিক ভিক্ষা তাঁকে ভাবতে শিখিয়েছে দেশভাগ এবং দেশে হিন্দুদের দুরবস্থার জন্য দায়ী গাঁধীজির রাজনৈতিক আদর্শ। সে দিন নাথুরাম শুধু গাঁধীজিকে হত্যা করেননি। এটি ছিল দুই বিপরীত রাজনৈতিক আদর্শের মুখোমুখি সংঘাত। যার এক দিকে ধর্মনিরপেক্ষ সকল সম্প্রদায়ের সমদর্শী গণতান্ত্রিক আদর্শ, অন্য দিকে হিংস্র হিন্দুত্ববাদ।

২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি। হিন্দু মহাসভার জাতীয় সেক্রেটারি শাকুন পান্ডে গাঁধীজির অবয়ব তৈরি করে তাতে গুলি চালিয়ে পালন করেন শহিদ দিবস। গুলি চালানোর পর কৃত্রিম ভাবে লাল রং ঢেলে দেওয়া হয়। শুরু হয় মিষ্টি বিতরণ।

Advertisement

ডক্টর মুনজে ও শ্রীসাভারকরের মতো যে সব হিন্দু, মুসলমানদের হিন্দুদের আধিপত্যে রাখার জন্য তলোয়ারের রাজত্ব প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী, আমি হিন্দুদের সেই অংশের প্রতিনিধি নই।
মহাত্মা গাঁধী, সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটিতে প্রদত্ত বক্তৃতা

২০২০, ৩০ জানুয়ারি। আর নকল বন্দুক, নকল রক্তের প্রয়োজন হয়নি। জামিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদী ছাত্রদের সামনে হঠাৎই বন্দুক হাতে হাজির হয় এক যুবক। স্লোগান তোলে— ‘এই নাও স্বাধীনতা’। এর পরেই এলোপাথাড়ি গুলিতে জখম হন প্রতিবাদী ছাত্র। হিন্দু মহাসভা থেকে পুরস্কৃত করার কথা ঘোষণা করা হয় সেই বন্ধুকবাজকে এবং তাকে নাথুরাম গডসের মতোই ‘দেশপ্রেমিক’ আখ্যা দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন: আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ধর্মের পরিত্রাতা?

এই ঘটনা কোনও তাৎক্ষণিক উত্তেজনা থেকে সৃষ্ট নয়। হিন্দু মহাসভা ও আরএসএস-এর জন্মলগ্ন থেকে ইতিবৃত্ত দেখলে যা স্পষ্ট হয়। হিন্দু মহাসভার জন্ম ১৯১০ সালে হিন্দুদের স্বার্থরক্ষার ঘোষিত উদ্দেশ্য নিয়ে। বঙ্গভঙ্গের সময়ে ব্রিটিশেরা হিন্দু-মুসলিম বিভাজন ও শাসননীতি প্রয়োগ করেছিল অত্যন্ত সুচারু ভাবে। যার ফল ছিল মুসলিম লিগ। এর পর মরলে মিন্টো সংস্কারে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আরও প্রবল হয়। গাঁধীজি অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে খিলাফতকে যুক্ত করেছিলেন জাতীয়তাবাদকে প্রবল করতে। এই সময় থেকেই হিন্দু মহাসভা স্পষ্ট ভাবে কংগ্রেস বিরোধী এবং জাতীয়তাবাদ বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করতে শুরু করে। যার অন্যতম প্রধান দিক ছিল ব্রিটিশদের সহযোগিতা করা।

গাঁধী পরিচালিত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে হিন্দু মহাসভা ছিল ব্রিটিশদের পক্ষে। ইংরেজ শাসকের নথি থেকে জানা যায়, বিয়াল্লিশের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে গোটা দেশ যখন উত্তাল তখন তারাই ছিল একান্ত ব্রিটিশভক্ত। এমনকি, এই স্লোগানও তোলা হয় ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই না করে মুসলিম, খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি হিন্দুদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কারণ তারাই নাকি দেশের প্রকৃত শত্রু। বিপান চন্দ্র যথার্থই বলেছেন, জাতীয় আন্দোলনের কথা বিবেচনা করলে হিন্দু মহাসভা, আরএসএস ও হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির সেখানে কোনও ভূমিকাই ছিল না। তারা আন্দোলনের কোনও অভিযানে অংশ নেয়নি। সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে একটিও গণ আন্দোলন সংগঠিত করেনি। উল্টে প্রকৃত জাতীয় আন্দোলন এবং তার নেতাদের উপরে আক্রমণ চালাত।

লেখক ইতিহাসের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন