ভাবি দুঃস্বপ্ন, তত কিছু নয়
Albert Camus

আমাদের স্মৃতিতে কোন ইতিহাস ধরা থাকে, আর কোনটা থাকে না

কামু হয়তো আজও এ কথাই বলতেন। আমাদের যৌথ স্মৃতি বার বার বিশ্বাসঘাতকতা করে, অতীতের বিপর্যয় থেকে পাওয়া শিক্ষা অতি দ্রুত বিস্মৃত হই আমরা।

Advertisement

ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০২০ ০১:১৫
Share:

ছবি: সংগৃহীত

সবাই জানে যে মহামারি পৃথিবীতে ফিরে ফিরে আসে, কিন্তু তবু হঠাৎ নীল আকাশ থেকে এমন একটা কিছু মাথায় ভেঙে পড়বে, এটা যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। ইতিহাসে যুদ্ধ যতগুলো হয়েছে, প্লেগও ততগুলোই হয়েছে, তবু প্লেগ এবং যুদ্ধে মানুষ একই রকম বিস্মিত হয়।”— ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসে কথাগুলো লিখেছিলেন আলব্যের কামু।

Advertisement

কামু হয়তো আজও এ কথাই বলতেন। আমাদের যৌথ স্মৃতি বার বার বিশ্বাসঘাতকতা করে, অতীতের বিপর্যয় থেকে পাওয়া শিক্ষা অতি দ্রুত বিস্মৃত হই আমরা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, বলশেভিক বিপ্লব এবং জালিয়ানওয়ালা বাগের কথা মনে রাখি, কিন্তু স্প্যানিশ ফ্লু-এর ব্যাপারে আমাদের প্রায় কারও কোনও ধারণাই নেই। অথচ ১৯১৮ থেকে ১৯২০-র মধ্যে সেই ফ্লু-এ গোটা বিশ্বে ৫ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে ছিল ভারত। এখানে মৃত্যুর সংখ্যা ১.৪ থেকে ১.৭ কোটি বলে অনুমান, অন্তত মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশ। এটাই সম্ভবত ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ানক মহামারি। অথচ কোভিড-১৯’এর হানার পর কয়েক জন মহামারি বিশেষজ্ঞ বিষয়টা খুঁড়ে বার না করলে প্রায় কেউই এ সম্পর্কে জানতে পারতেন না।

সামাজিক স্মৃতি কী ভাবে বেছে বেছে তৈরি হয়, এই রহস্য সত্যিই অবাক করে। এ-ও বুঝিয়ে দেয় যে অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে মানবসভ্যতা তার সাড়া দেওয়ার প্রক্রিয়াকে আরও উন্নত করে, এই ধারণাটা আসলে ঠিক নয়। বাস্তব হল, আমরা বাছা বাছা কথাই মনে রাখি। যুদ্ধকে মনে রাখি, সম্ভবত তা আমাদের নায়ক এবং জয়ের কাহিনি শোনায় বলে। মহামারির তো নায়ক নেই। শুধু আছে অদেখা, অদৃশ্য একটা শক্তি— যা গণহারে মৃত্যু ঘটায়। যুদ্ধ বা রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের সময় বেশির ভাগ মানুষের জীবনই স্বাভাবিক ভাবে চলে। এত মৃত্যু ও হিংসার পরেও। বিপরীতে, মহামারি আমাদের সকলকেই বন্দি করে। তবু যেন তত কিছু পাল্টায় না।

Advertisement

‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসে কামু দেখিয়েছিলেন, “অনেকেই আশা করেছিল যে মহামারি চলে যাবে এবং তারা তাদের পরিবার-সহ বেঁচে যাবে। তাই এখনও অবধি তারা নিজেদের অভ্যাসে কোনও পরিবর্তন আনার কথা ভাবেনি। প্লেগ যেন অনাহূত এক অতিথি, যেমন আকস্মিক ভাবে সে এসেছিল, তেমন ভাবেই যেন তার চলে যাওয়ার কথা।”

বহু জায়গায়, বহু সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে অতিমারির বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা রয়েছে। মানুষ সুযোগ পেলেই বাজার ও অন্যান্য প্রকাশ্য স্থানে ভিড় জমায়, ধাক্কাধাক্কি করে। যেন সচেতন ভাবেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নিয়মগুলো ভুলে যেতে চায়।

তাই বিশ্বের সর্বত্র লোকের একই রকমের অবিবেচক আচরণ, যেন মহামারি বলে আসলে কিছু নেই। ১৮৬৭ সালে বাংলায় যখন কলেরা মহামারি তুঙ্গে ওঠে, পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে তীর্থযাত্রা বন্ধ করার বৃথা চেষ্টা করে ব্রিটিশ প্রশাসন। প্রচুর তীর্থযাত্রী মারা যাচ্ছিলেন, রোগও ছড়াচ্ছিল ওই পথেই। তীর্থযাত্রা বন্ধ করতে সরকারের সেই আবেদন কী ভাবে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল, সে বিষয়ে পরে লিখেছিলেন ইতিহাসবিদ উইলিয়াম উইলসন হান্টার: “মানুষের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করার কোনও ইচ্ছা নেই এ কথা জানিয়েও জনতার কাছে আবেদন করেছিলেন ভাইসরয়। তিনি বলেন যে জগন্নাথে তীর্থযাত্রার ফলে যে ‘বিপন্নতা, রোগ এবং মৃত্যু’ ঘটছে তা ভেবে দেখা উচিত।” কিন্তু বাংলার প্রত্যেকটি জায়গা থেকেই যে উত্তর আসে, তাতে আশার আলো দেখা যায় না। (শেষ পর্যন্ত) স্বাস্থ্য-নজরদারি এবং কোয়রান্টিনের প্রাতিষ্ঠানিক বন্দোবস্ত ছাড়া আর কোনও পথ খোলা থাকে না, যা অবশ্যম্ভাবী প্রাণহানির সংখ্যা কমিয়ে আনতে পারে। তবুও বাংলায় লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। সেটা সবে শুরু। মক্কাগামী মুসলমান তীর্থযাত্রীরা এই রোগ আরবে নিয়ে যান, যেখান থেকে তা গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়, কিন্তু তীর্থযাত্রা থামেনি।

১৯১৮-র স্প্যানিশ ফ্লু মহামারির চূড়ান্ত পরিস্থিতিতে, সান ফ্রান্সিসকো শহরে ফেস মাস্ক পরার প্রতিবাদে জনসভায় জড়ো হন হাজার হাজার মানুষ। মহামারি ও মাস্ক পরার চোটে ভয়ানক ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন তাঁরা। প্রতিবাদের পর সকলে মাস্ক পরিত্যাগ করেন। তার পরেই ঘটল গণহারে মৃত্যু।

চিন্তার কথা, স্প্যানিশ ফ্লুয়ের এক শতাব্দী বাদে যখন করোনাভাইরাস অতিমারি গোটা পৃথিবীতে ছেয়ে গিয়েছে, তখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অংশে ঠিক একই ধরনের প্রতিবাদ হচ্ছে। আমেরিকার বিভিন্ন মলে শোনা গিয়েছে, মাস্ক পরতে বলায় ক্রেতাদের হাতে হেনস্থার শিকার হয়েছেন মলের কর্মীরা। কোথাও আবার সরকারি লকডাউনের বিধিনিষেধের বিপক্ষে প্রতিরোধের হুঁশিয়ারি দিয়ে রাস্তা দখল করেছেন অস্ত্রধারী নাগরিকেরা। বিশ্ব জুড়ে বহু শহরেই প্রকাশ্যে সামাজিক দূরত্ববিধি অবজ্ঞা করছেন মানুষ। অনেক শহরে শোনা যাচ্ছে, নিয়মিত হুল্লোড়-ফুর্তিতে ব্যস্ত যুব সমাজ। ভারতে গত দুই মাসের লকডাউন সত্ত্বেও পরিচারক এবং অন্যান্য সহায়ক কর্মীকে কাজ শুরু করার জন্য অনুরোধ করেছে উদ্বিগ্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি। প্রিয় রেস্তরাঁ থেকে খাবারের অর্ডার দেওয়ার আগে দু’বার ভাবেননি বহু লোক। বাজারে ভিড় ছিল, ছিল ব্যাপক ঔদাসীন্য।

এখানে আবারও, ‘দ্য প্লেগ’ থেকে একটা অনুচ্ছেদ তুলে ধরতে হয়— “এই ক্ষেত্রে আমাদের নাগরিকেরা বাকি সকলের মতোই নিজেদের নিয়েই বিভোর; অন্য ভাবে দেখলে, তাঁরা মানবতাবাদী: তাঁরা মহামারিতে বিশ্বাস করেন না। মানুষের পক্ষে মহামারি পরিমাপ করা সম্ভব নয়; অতএব আমরা নিজেরা নিজেদের বলি যে, মহামারি আসলে মনের ভূত, একটা দুঃস্বপ্ন, যা ক্রমে কেটে যাবে। কিন্তু আসলে তা সব সময় কেটে যায় না— একটা দুঃস্বপ্ন থেকে আর একটা দুঃস্বপ্নে পৌঁছয় মানুষ। সবচেয়ে আগে পৌঁছন মানবতাবাদীরাই, কারণ তাঁরা কোনও সতর্কতা অবলম্বন করেন না।”

আজকের বিশ্বে ‘মানবতাবাদী’দের সংখ্যা প্রচুর। এ রকম লোকও প্রচুর আছেন, যাঁরা কিছুতেই অভ্যাস পাল্টাবেন না। তাঁদের জীবনযাত্রা অলঙ্ঘনীয়: সেটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘আমেরিকান’ জীবনযাত্রা হতে পারে, মুসলমান দুনিয়ার যৌথ ধর্মানুরাগ হতে পারে, ইউরোপের চরম ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারা হতে পারে, এশিয়ার বিভিন্ন অংশে বিচিত্র জাতের মাংস খাওয়ার চল হতে পারে, কিংবা ভারতে গৃহ-সহায়ক পরিষেবার মৌলিক অধিকার হতে পারে।

কোন জিনিসটা সমাজ অগ্রাহ্য করে এবং তার পর হিসেব কষে ভুলে যায়, সেই পদ্ধতি বোঝার কোনও চেষ্টাও এখনও পর্যন্ত হয়নি। সমাজতাত্ত্বিক গবেষণা বলে, নির্বাচিত বিস্মৃতি আসলে যৌথ স্মৃতি নির্মাণের জটিল প্রক্রিয়ার অংশ। তবে এখনও পর্যন্ত কেউ উদ্ধার করতে পারেননি যে, মানবসভ্যতা কোন জিনিসটা কখন মনে রাখবে বলে ঠিক করছে, এবং বাকিটা যৌথ বিস্মৃতিতে ঠেলে দিচ্ছে।

সাংবাদিক এবং অন্যান্য ভাষ্যকারেরা আজকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে ১৯১৮-র স্প্যানিশ ফ্লু-এ মহাত্মা গাঁধীর প্রাণ সংশয় হয়েছিল। তা ঘটলে ইতিহাসের গতি পাল্টে যেত। তরল পথ্য এবং যথাযথ যত্নের ফলে তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন। তাঁর লক্ষাধিক সহনাগরিক বাঁচেননি। এর বেশির ভাগটাই বিস্মৃত, কিন্তু নিকট অতীত মানুষ ভোলে না, ক্ষমাও করে না। ১৯১৮-২০’তে ভারতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভেঙে পড়া এবং অতিমারির হাত থেকে নাগরিকদের বাঁচাতে ব্রিটিশ প্রশাসনের চূড়ান্ত ব্যর্থতায় তাদের আধিপত্যের পালিশ অনেকটাই মুছে যায়। ভারতীয়রা প্রবল বিরক্ত হয়। এই প্রথম বার জনতা বুঝতে পারে যে শাসক তাদের বঞ্চনা করছে। একটা বিপুল পরিবর্তনের এটাই ছিল সূত্রপাত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন