বীভৎস মজা

কর্ণ জোহর জানাইয়াছেন, যে প্রশ্ন তিনি সকলকেই করেন, হার্দিকদেরও করিয়াছিলেন। উত্তরের উপর তাঁহার নিয়ন্ত্রণ ছিল না। নিজের উপর তো ছিল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:৩২
Share:

হার্দিক পাণ্ড্য ক্ষমা চাহিয়া লইয়াছেন। অবশেষে কর্ণ জোহরও ক্ষমা চাহিলেন। অতঃপর কি নটে গাছটি মুড়াইবে? একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে কোনও এক ক্রিকেটার কী মন্তব্য করিলেন, সেই তর্ক ফুরাইতেই পারে। যে আলোচনাটিকে জিয়াইয়া রাখা উচিত, তাহা এই খেলোয়াড় বা সঞ্চালকের তুলনায় মাপে অনেক বড়। তর্কটি শিক্ষার। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নহে— মূল্যবোধ, ঔচিত্যবোধের শিক্ষা। কোন কথা গণপরিসরে বলা চলে না— বস্তুত, কী ভাবে ভাবিতে নাই— এই কথাগুলি বুঝিতে যে মূল্যবোধের প্রয়োজন, ভারতের গণপরিসরে তাহার অভাব প্রকট। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড জানাইয়াছে, জাতীয় দলের সকল খেলোয়াড়ের জন্য প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করিবার ভাবনা চলিতেছে। সমস্যা যদিও শুধু ক্রিকেটারদের লইয়াই নহে। পেশানির্বিশেষে সফল ভারতীয়দের একটি অংশ মহিলাদের সম্বন্ধে এমন রুচিহীন মন্তব্য করিতে অভ্যস্ত। কর্ণ জোহরের অনুষ্ঠানটি বৎসরের পর বৎসর সেই কদর্যতার সাক্ষ্য বহন করিয়াছে। পূর্বে বিতর্ক হয় নাই, ফলে কর্ণকেও ক্ষমাপ্রার্থনা করিতে হয় নাই। হার্দিক-পর্বের প্রতিক্রিয়ায় অনুষ্ঠানটির এমন একাধিক ভিডিয়ো ক্লিপিং সোশ্যাল মিডিয়ায় আসিয়াছে, যে বক্তব্যগুলির অনৌচিত্য হার্দিকদের মন্তব্যের তুলনায় বিন্দুমাত্র কম নহে। এই সামূহিক অ-শিক্ষাকে কি একটিমাত্র ক্ষমাপ্রার্থনায় মুছিয়া দেওয়া সম্ভব?

Advertisement

কর্ণ জোহর জানাইয়াছেন, যে প্রশ্ন তিনি সকলকেই করেন, হার্দিকদেরও করিয়াছিলেন। উত্তরের উপর তাঁহার নিয়ন্ত্রণ ছিল না। নিজের উপর তো ছিল। হার্দিকদের (এবং পূর্বের আরও বহু সাক্ষাৎকারেও) রুচিহীন উত্তরের প্রতিক্রিয়াটি সহাস্য অনুমোদনের পরিবর্তে তীব্র তিরস্কার হইতে পারিত। তরুণ ক্রিকেটারদের তিনি স্মরণ করাইয়া দিতে পারিতেন, এই নারীবিদ্বেষ সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য নহে। অন্তত, সম্প্রচারের পূর্বে এই কুরুচিকর অংশটি তিনি ছাঁটিয়া দিতে পারিতেন। করেন নাই, কারণ তিনি স্বীকার করুন আর না-ই করুন, এই নারীবিদ্বেষের মধ্যে, নারীকে কেবল যৌন আকর্ষণের বস্তু হিসাবে দেখিবার মধ্যে যে কোনও অন্যায় আছে, তাহাকে ধিক্কার জানাইবার প্রয়োজন আছে, সাক্ষাৎকার চলাকালীন কর্ণ জোহরের তাহা মনে হয় নাই। সাক্ষাৎকার মিটিবার পরও নহে। নারীর সম্পূর্ণতাকে ছাঁটিয়া শুধুমাত্র যৌনপিণ্ডে পরিণত করিবার মধ্যে পৌরুষতন্ত্র যে মজা খুঁজিয়া পায়, রসিকতা দেখে, কর্ণ জোহরও তাহাই পাইয়াছিলেন। তাঁহার অনুষ্ঠানটিকে সাক্ষ্য মানিলে বলিতে হয়, তিনি দলে ভারী। কতিপয় ব্যতিক্রম বাদে সেলেব্রিটিরা এই মজাতেই অভ্যস্ত। নারীরাও দৃশ্যত মানিয়া লহেন। পুরুষতন্ত্রের জঠরে জীবিকা অর্জন করিতে হইলে অনেক কিছুই মানিয়া লইতে হয় বলিয়াই হয়তো।

তারকারা এই সমাজেরই সন্তান। এক অর্থে সমাজের পিতাও বটে। সমাজ যে পুরুষতন্ত্রকে মান্যতা দেয়, তাঁহারাও অবলীলায় তাহার বাহক হইয়া যান। আবার, তারকাদের মুখে পুরুষতন্ত্রের জয়ধ্বনিতে সমাজও শিখে, ইহাই দস্তুর। মহিলাদের যৌনবস্তু হিসাবে দেখার মধ্যে, বর্ণবিদ্বেষের মধ্যে মজা আছে। বীভৎস মজা। সমাজ মজার কাঙাল। অতএব, তারকাখচিত অনুষ্ঠানের পর্দা হইতে নামিয়া সেই মজা সমাজের অলিগলিতে ঘুরিয়া বেড়ায়। ভবিষ্যতের হার্দিকরা সেই গলি হইতেই মজাগুলি শিখিয়া লইবে, জীবনচর্যার অঙ্গ করিয়া ফেলিবে। কর্ণ জোহরের ক্ষমাপ্রার্থনায় এই বাস্তবে তিলমাত্র পরিবর্তন হইবে না। পাল্টাইবার জন্য শিক্ষা প্রয়োজন। নারীকে সম্মান করিবার শিক্ষা, ভিন্নতাকে শ্রদ্ধা করিবার শিক্ষা। সহনশীলতা, সহাবস্থানের শিক্ষা। দায়িত্ব প্রত্যেকের। অভিভাবকদের, স্কুল-কলেজের। সমাজের মাথাদেরও। বিশ্বাস শুধরাইতে পারিলে ভাল। অন্তত, গণপরিসরে কোন কথা বলিতে নাই, তারকারা এই বার সেটুকু শিখিয়া লইলেও মঙ্গল।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন