দায়বোধ

এই হত্যাকাণ্ড কাহাদের কীর্তি, তাহা লইয়া বড় রকমের সংশয় বাতাসে ভাসিতেছে। সরকারি শিবির লস্কর-ই-তইবার উদ্দেশে আঙুল তুলিতেছে, লস্করের অভিযোগ— ইহার পিছনে রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের ভূমিকা আছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৮ ০০:২১
Share:

ছবি: পিটিআই।

ভয়াবহ মৃত্যুর আগে জম্মু ও কাশ্মীরের সাংবাদিক-সম্পাদক শুজাত বুখারির সমাজমাধ্যমে তাঁহার সুস্পষ্ট বার্তা ছিল: আমরা কাশ্মীরে গর্বের সহিত সাংবাদিকতার কাজ করিয়া আসিয়াছি এবং যাহা ঘটিতেছে তাহার বিবরণ দিয়া চলিব। তাহার পাশাপাশি এই স্পষ্টবাক স্বাধীনচেতা রাষ্ট্রপুঞ্জের সাম্প্রতিক একটি রিপোর্টের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া লিখিয়াছিলেন— কাশ্মীর উপত্যকা সম্পর্কে এই ধরনের প্রথম রিপোর্টে রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার সংস্থা আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানের দাবি জানাইয়াছে। জম্মু ও কাশ্মীরে স্বাধীন সাংবাদিকতা কতখানি বিপদসঙ্কুল, তাহা শুজাত বুখারি জানিতেন। কিন্তু সেই জানা তাঁহার নির্ভীক চেতনা ও দায়বোধকে প্রতিহত করিতে পারে নাই, তিনি নিরবচ্ছিন্ন ভাবে কাশ্মীরে ন্যায়ের পক্ষে কথা বলিয়া গিয়াছেন, অন্যায়ের সমালোচনা করিয়া আসিয়াছেন। যেমন রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের, তেমনই জঙ্গিদের অন্যায়ের। স্বধর্মের প্রতি দায়বদ্ধতার গুরুত্ব ঠিক কতটা, আপন প্রাণের বিনিময়ে তিনি সেই কথা জানাইয়া গেলেন।

Advertisement

এই হত্যাকাণ্ড কাহাদের কীর্তি, তাহা লইয়া বড় রকমের সংশয় বাতাসে ভাসিতেছে। সরকারি শিবির লস্কর-ই-তইবার উদ্দেশে আঙুল তুলিতেছে, লস্করের অভিযোগ— ইহার পিছনে রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের ভূমিকা আছে। শ্রীনগরের প্রাণকেন্দ্রে ভরসন্ধ্যায় সুপ্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্রের অফিসের সামনে তিন আততায়ীর সশস্ত্র প্রতীক্ষা— জঙ্গি আক্রমণ হিসাবেও— স্বাভাবিক নহে। স্পষ্টতই, সংশয় কেবল গভীর নহে, অত্যন্ত জটিল। কিন্তু একটি বিষয়ে কিছুমাত্র সংশয় নাই। এই হত্যায় একটি ভয়ঙ্কর বার্তা নিহিত রহিয়াছে। ভীতি ও উদ্বেগ ছড়াইবার বার্তা। মুক্তকণ্ঠ নিষ্পেষণের বার্তা। শুজাত বুখারি এক দিকে জঙ্গিদের ভর্ৎসনা করিয়া গিয়াছেন পৈশাচিক হত্যালীলা চালাইবার জন্য। অপর দিকে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলিয়াছেন আলোচনার উপযুক্ত অবকাশ তৈরির দিকে মন না দিবার জন্য। গত মাসে নরেন্দ্র মোদীর কাশ্মীর সফরের সময়ও তাঁহার দৃপ্ত সমালোচনা শোনা গিয়াছিল, বহুপাক্ষিক আলোচনার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী কেন যথেষ্ট প্রয়াস লন নাই, সেই প্রশ্ন তুলিয়াছিলেন তিনি। এমন মুক্তমনা নিরপেক্ষ সাংবাদিকের দিকে যখন বুলেট ধাবিয়া আসে, বোঝা যায়, কেহ বা কাহারা ভয় দেখাইয়া ভিন্ন মতকে কাশ্মীর উপত্যকা হইতে লুপ্ত করিতে চাহিতেছে।

হত্যার সময় নির্বাচনটিও তাৎপর্যপূর্ণ। রমজান উপলক্ষে— সেনাবাহিনীর ভিন্নমত সত্ত্বেও— যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করিয়াছিল ভারত সরকার। অথচ তাহারই মধ্যে উপত্যকায় লাগাতার রক্তক্ষয় ঘটিয়াছে। যেন ইহাই প্রমাণ করিবার লক্ষ্যে যে, কাশ্মীরে আসলে সংঘর্ষের কোনও ‘বিরতি’র প্রশ্ন নাই। শুজাত বুখারির হত্যা যাহাদেরই কীর্তি হউক, তাহা স্পষ্টতই যু্দ্ধবিরতি প্রত্যাহারের সহায়ক হইয়াছে। জঙ্গিরা জঙ্গির কাজ করিবে, ঘৃণ্য বা কাপুরুষোচিত গোছের বহুব্যবহৃত বিশেষণ তাহাদের কিছুমাত্র বিচলিত করিবে না। কিন্তু রাষ্ট্রের— তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের— দায়িত্ব, আপসহীন তদন্তের মাধ্যমে হত্যাকারীদের শনাক্ত করা ও শাস্তির ব্যবস্থা করা, সেই হত্যাকারী যে শিবিরেরই হোক। এমন একটি ঘটনার পরেও প্রধানমন্ত্রী নীরব। দেশ এখন এই নীরবতায় অভ্যস্ত। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর মন কি বাত যাহাই হউক, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিক ও সাংবাদিক মহল আরও এক বার শপথ লইবে: শুজাত বুখারির নিধন নিরপেক্ষ সংবাদ প্রকাশ ও প্রচারকে ব্যাহত করিতে পারিবে না। ভয় দেখাইয়া জয় করিতে পারিবে না। তাঁহার সহকর্মীদের সাহসী প্রতিক্রিয়া এবং তাঁহার সংবাদপত্রের নিরবচ্ছিন্ন প্রকাশনা সেই প্রত্যয়কে জোরদার করে। এই অন্ধকারে ওইটুকুই ভরসা।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন