শাসক যে দলেরই হোক

বাস্তব হল, প্রশাসন ও পুলিশের কর্তারা এক শ্রেণির রাজনীতিকের অঙ্গুলিহেলনে বাক্‌স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

Advertisement

আনন্দ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share:

রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ করার পর সমস্ত রাজনৈতিক দলই দাবি করে থাকে, নাগরিকের বাক্‌স্বাধীনতার অধিকার নিরঙ্কুশ হতে পারে না। ভারতীয় সংবিধান তাকে সে অধিকার দেয়নি। কিন্তু ক্ষমতা হারানোর পর তারাই শাসকের বিরুদ্ধে বাক্‌স্বাধীনতা হরণের অভিযোগ তুলতে থাকে। সত্তর বছর ধরে ভারতীয় জনগণ এই পরম্পরাই দেখতে অভ্যস্ত। প্রশ্ন হল, বাক্‌স্বাধীনতার পরিধি লঙ্ঘিত হল কি না বা কতখানি লঙ্ঘিত হল, তার সীমারেখা নির্ধারণ করবে কে? প্রশাসন, পুলিশ, আমলাতন্ত্র, রাজনৈতিক নেতারা?

Advertisement

বাস্তব হল, প্রশাসন ও পুলিশের কর্তারা এক শ্রেণির রাজনীতিকের অঙ্গুলিহেলনে বাক্‌স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সর্বভারতীয় স্তরে ইদানীং আবার গেরুয়াবাহিনীর দাপট, নাগরিক সমাজের মতপ্রকাশের সীমারেখা নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে নীতি পুলিশের যাবতীয় ভূমিকা পালনে প্রশাসনিক কর্তাদেরও হার মানাচ্ছে তারা। নরেন্দ্র দাভোলকর, গোবিন্দ পানসারে, এম এম কালবুর্গি, গৌরী লঙ্কেশ, গৌহর রাজা (উর্দু কবি), প্রয়াত কন্নড় ভাষাবিদ ইউ আর অনন্তমূর্তি, কাঞ্চা ইলাইয়া (‘পোস্ট-হিন্দু ইন্ডিয়া’ গ্রন্থের লেখক), পেরুমল মুরুগন বা কার্টুনিস্ট জি বালকৃষ্ণণ— একের পর এক লেখক, শিল্পী, সমাজকর্মী স্বাধীন মতপ্রকাশের জন্য নিহত বা আক্রান্ত, সন্ত্রস্ত বা রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে গ্রেফতার।

এ রাজ্যেও প্রশাসনিক স্তরে সেই একই প্রবণতা গণতান্ত্রিক ক্ষেত্রকে সংকুচিত করতে উদ্যত। ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে ব্যঙ্গচিত্র সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করার দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ২০১৬-তেও রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায় নামক এক ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রকে ফেসবুকে মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। সম্প্রতি দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটে দেবজিৎ রায় ও অনুপম তরফদার নামক দুই ব্যক্তিকে যে অভিযোগে গ্রেফতার করে হাজতে পুরে দেওয়া হল, সে ঘটনায় সভ্য নাগরিক সমাজ স্তম্ভিত, বাকরুদ্ধ। যা জানা গিয়েছে, গত ২৭ সেপ্টেম্বর দুর্গাপুজোর দিন অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ও আঠারো মাসের সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় কোনও যান না পেয়ে বাধ্য হয়েই পাঁচ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরেন দেবজিৎবাবু ও তাঁর পরিবার। বস্তুত, সে অঞ্চলে পুজোর দিনগুলিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার লক্ষ্যে বিকেল চারটে থেকে ভোর চারটে পর্যন্ত টোটো, রিকশার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল পুলিশ। বিরক্ত অভিজিৎবাবু সোশ্যাল সাইটে কয়েকটি প্রতিবাদ পোস্ট করেছিলেন, যেখানে পুলিশের ইঙ্গিতপূর্ণ সমালোচনা ছিল। একটি পোস্টে তিনি লেখেন, ‘অষ্টমীর দিন, ১৮ মাসের শিশুকে কোলে নিয়ে ৫৫ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকেও যখন টোটো পাচ্ছিলাম না, তখন আপনার কথা খুব মনে পড়ছিল— যদি আপনার কোনও হেল্প ডেস্ক-এ ফোন করে হেল্প পাওয়া যেত... কিন্তু...’ পুলিশের প্রতি এ ধরনের আবেদন বা সাহায্যপ্রার্থনা রাজ্যের কোনও নাগরিককে হাজত পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারে! এবং, এমন সাধারণ ও নিরীহ পোস্ট শেয়ার করার অপরাধে পেশায় ব্যাংককর্মী অনুপম তরফদার নামক আর এক জনকেও গ্রেফতার করে পুলিশ। এঁদের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের পাশাপাশি ভারতীয় দণ্ডবিধির একাধিক ধারায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, যার মধ্যে সরকারি প্রতিনিধিকে কাজে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বলপ্রয়োগ, অসহযোগিতা, ঘৃণা বা দ্বেষ উদ্রেককারী বিবৃতি দেওয়ার অভিযোগও আছে।

Advertisement

শুধু এঁরাই নন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক কনক সরকারও সম্প্রতি পুলিশি হয়রানির শিকার। দীর্ঘদিন ধরে আইন ও পুলিশ-প্রশাসনের ওপর গবেষণা করার সুবাদে পুলিশের অভ্যন্তরের বহু বিষয় জানেন তিনি। সম্প্রতি দার্জিলিংয়ে ঘটা পুলিশকর্মীর মৃত্যুতে যখন রাজ্য জুড়ে শোকের ছায়া, তখন নিজের ফেসবুক পোস্টে পুলিশের কাজকর্মের সমালোচনা করে কনকবাবু লেখেন, তিনি এত খারাপ কাজ করতে পুলিশকে দেখেছেন যে, কোনও পুলিশকর্মীর মৃত্যুতেও দুঃখপ্রকাশ করতে পারছেন না। এর পর থেকেই ওই পোস্টটি তুলে নেওয়ার জন্য তাঁকে পুলিশের বিভিন্ন মহল থেকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে সাইবার ক্রাইম থানায় অভিযোগ জানিয়েছেন এই অধ্যাপক।

পুলিশের সম্পর্কে এমন অভিজ্ঞতা তো বহু নাগরিকেরই অল্পবিস্তর রয়েছে। সে কথা প্রকাশ্যে বললেই যদি হিংসা বা বিদ্বেষ ছড়ানো, দেশদ্রোহিতা বা সরকারি ব্যক্তির কাজে বাধা দেওয়ার মতো অভিযোগ তোলা হয়, তা হলে তো সোশ্যাল সাইটগুলোর অস্তিত্বই অর্থহীন হয়ে পড়া। শুধুমাত্র ফুল-ফল-পাখির ছবি বা জন্মদিনে সেলফি পোস্ট করার বাইরে কোনও সামাজিক, রাজনৈতিক বিষয়ে মন্তব্য করলেই যদি প্রশাসনের রক্তচক্ষুর শিকার হতে হয়, সে ক্ষেত্রে নাগরিকের স্বাধীন ভাবে মতপ্রকাশের অধিকার আদৌ কতখানি সুরক্ষিত রয়েছে! আর প্রশাসনের এই রণং দেহি মানসিকতার সবচেয়ে বড় শিকার হবেন সাংবাদিক, আলোকচিত্রী, বিশেষত ব্যঙ্গচিত্রীরা।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষা থেকে শুরু করে মামলার চার্জশিট নির্দিষ্ট সময়ে আদালতে জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশের তৎপরতা সুলভ নয়। নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণে কিন্তু পুলিশ-প্রশাসন অতিসক্রিয়। সরকার ঘোষিত উন্নয়ন বা প্রশাসনের ভুলত্রুটি, অন্যায়, নীতিহীনতা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় মুখ খুললেই ভারতীয় দণ্ডবিধির পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিভিন্ন ধারায় অভিযুক্তকে জড়িয়ে গ্রেফতার করা হচ্ছে। ফলে গণতান্ত্রিক পরিসর সংকুচিত হয়ে আসছে। ব্যক্তিপরিসরেও সরকার ও পুলিশের হস্তক্ষেপ বেড়েই চলেছে। সময় এসেছে, শাসকের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে একযোগে প্রতিবাদ জানানোর। একটা কথা মনে রাখা দরকার। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার এক্তিয়ার নির্দিষ্ট করার জন্য এ দেশে এখনও আদালতের দরজা খোলা রয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন