মুড়ি ও মিছরি

অমর্ত্য সেনকে বলা হইতেছে, উনি তো বিদেশে থাকেন, এ দেশের কী বুঝিবেন? উনি তো গাড়ি চড়িয়া ঘুরিয়া বেড়ান, মানুষের সহিত তাঁহার জানাশোনা হইবে কী রূপে?

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৯ ০০:৫৪
Share:

অমর্ত্য সেন কিছু কথা বলিয়াছেন যাহা অনেকের ভাল লাগে নাই। তাঁহারা অধ্যাপক সেন-এর বিরুদ্ধে কথা বলিতেছেন। বলিতেই পারেন, সকলেই নিজ মতামত প্রকাশ করিবেন, ইহাই বাক্‌স্বাধীনতার শর্ত, গণতান্ত্রিক সমাজের কান্তি। অমর্ত্যবাবু নোবেল পাইয়াছেন বলিয়া তাঁহার বিরুদ্ধে কথা বলা যাইবে না, সেই আধিপত্যবাদকে অবশ্যই প্রশ্রয় না দেওয়া উচিত। কিন্তু প্রশ্ন হইল, তাহা বলিয়া কি সমগ্র সমাজ হইয়া যাইবে সমাজমাধ্যমের ন্যায়, যেইখানে মুড়ি ও মিছরির কোনও পার্থক্য নাই, যেখানে অজ্ঞ আসিয়া প্রতিনিয়ত মহাচিন্তকের নাসিকার সম্মুখে তুড়ি বাজাইয়া যায়, সস্তা গালাগাল হানিয়া শিক্ষিত তর্কের ঝুঁটি নাড়িয়া অশ্লীল দন্ত বাহির করিয়া হাসে, স্রেফ সে কাজটি করিবার অধিকার পাইয়াছে বলিয়াই? অমর্ত্যবাবুর বক্তব্যের সমালোচনা করিতে যাইলে কেবল জিঘাংসা ও আক্রোশ যথেষ্ট নহে, পণ্ডিতের কথার উত্তরে কেবল বিদ্রুপ ব্যবহার করা যায় না। তাহার জন্য যুক্তি, ভাবনা ও রুচির প্রয়োজন। মুশকিল হইল, ইদানীং এই রাজ্যে অযুক্তি, ভাবনাহীনতা ও কুরুচির রমরমা চলিতেছে। হোয়াটসঅ্যাপ হইতে দূরদর্শনের দৈনিক কলহে তাহারই প্রতিফলন।

Advertisement

অমর্ত্য সেনকে বলা হইতেছে, উনি তো বিদেশে থাকেন, এ দেশের কী বুঝিবেন? উনি তো গাড়ি চড়িয়া ঘুরিয়া বেড়ান, মানুষের সহিত তাঁহার জানাশোনা হইবে কী রূপে? প্রথমত অমর্ত্যবাবু ভারত ও বাংলার সমাজের অনুপুঙ্খ লইয়া কতখানি অবহিত, এ দেশের শিক্ষা ও সমাজের উন্নতির জন্য তিনি কী পরিমাণ কাজ করিয়া থাকেন, তাহা সামান্য চেষ্টাতেই জানা সম্ভব। কিন্তু এই সবের কোনওটিই বড় কথা নহে। অন্য দেশে থাকিলে এই দেশ লইয়া কথা বলা যাইবে না, ইহা কোথাকার যুক্তি? ভারতে থাকিলে কেহ সৌদি আরবের নারীর অধিকার লইয়া কথা বলিতে পারিবে না? প্যারিসে ইসলামি মৌলবাদী সন্ত্রাস ঘটিলে কেহ তাহা লইয়া টুঁ শব্দ করিবে না? এই কথা বিজেপির অমর্ত্য-বিরোধী নেতাগণ মানিয়া চলেন তো? বাংলার সংস্কৃতি বিষয়ে কথা বলিবার অধিকার কেবল শ্রমিকশ্রেণির রহিয়াছে, গাড়ি চড়িয়া বেড়াইলে ফুটপাতের মানুষের জীবন লইয়া টুঁ শব্দ করা যায় না, ইহা মানিয়া লইলে তো কোনও জমিদারতনয় ‘ওরা কাজ করে’ পঙ্‌ক্তি লিখিলে তখনই কলম কাড়িয়া শ্রমিকদের মধ্যে বিলাইয়া দিতে হয়!

আসলে, এই কথাগুলির নেপথ্যে রহিয়াছে পাণ্ডিত্যের প্রতি, চিন্তার প্রতি, বিদ্যার প্রতি— ক্রোধ ও বিরাগ। যাহা ফ্যাসিবাদী শক্তির আবশ্যিক চরিত্রলক্ষণ। তাহারা বই পুড়াইতে ভালবাসে। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সেমিনার ভন্ডুল করিতে ভালবাসে। বলিতে ভালবাসে, ডারউইন মিথ্যা কারণ কেহ তো বাজারপ্রাঙ্গণে বানরকে মানুষে রূপান্তরিত হইতে দেখে নাই। তাহারা ভাবনার সংস্কৃতি সম্পূর্ণ বিলোপ করিয়া প্রশ্নহীন বোধহীন আনুগত্যের চাষ করিতে চাহে, শিক্ষাবিরোধিতা তাহাদের ইস্তাহারের অলিখিত অথচ প্রধান কর্তব্য। যে মানুষ ভাবিতে ভুলিয়াছে, তাহার অন্তরে বিদ্বেষ বপন সহজ, তাহাকে গণপ্রহারে মাতাইয়া দেওয়া সহজ। তাই উগ্র দক্ষিণপন্থীরা ক্রমাগত ইতিহাস ও পুরাণ গুলাইয়া দেয়, কুসংস্কার ও বিজ্ঞান মিশাইয়া দেয়, জ্যোতিষকে হাসপাতালে উপস্থিত করে, গণেশের মুণ্ডকে প্লাস্টিক সার্জারির টেবিলে। ইহাতে অশিক্ষিত দেশের জনগণ হীনম্মন্যতা ত্যাগ করিয়া এই পুলক-আলোকে জাগিয়া উঠে যে তাহাদের মূর্খতা ও লোকবিশ্বাসই তবে প্রকৃত জ্ঞান, যাঁহারা বিদ্বজ্জন বলিয়া পরিচিত, তাঁহারা বাস্তবিক ভণ্ড আঁতেল, তাঁহাদের কথার দুর্বোধ্যতা তাঁহাদেরই অক্ষমতাজনিত, শ্রোতার প্রস্তুতিহীনতার পরিণাম নহে। ইহাতে জনতার অগভীরতা গুরুত্ব পায়, অর্বাচীনের অসভ্য উপহাস পায় সমৃদ্ধ সমালোচনার মর্যাদা। অমর্ত্য সেনের জ্ঞান লইয়া ব্যঙ্গ করিবার স্পর্ধা হয়তো তাহারা সংগ্রহ করে ‘বিদ্যাসাগর লিখিত সহজ পাঠ’ হইতে!

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন