অাজ শ্রীশ্রীমা সারদার ১৬৫তম জন্মতিথি
মহাসমাধির আগে শ্রীরামকৃষ্ণের শ্রীমা সারদাকে ‘সমস্যায় কিলবিল করা আন্তর্জাতিক’ মহানগরী কলকাতার (সমকালীন ভারতবর্ষের রাজধানী) মানুষজনের সার্বিক দেখভালের দায়িত্ব অর্পণ কিংবা ১৮৭২-এ ফলহারিণী কালীপুজোর দিন ষোড়শী রূপে সারদাকে শ্রীরামকৃষ্ণের পূজা নিবেদনে সারদার মধ্যে মহাশক্তির জাগরণ ঘটানো বা প্রথম বার পাশ্চাত্য পরিক্রমা শেষে স্বামী বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠাকালে (১৮৯৭) সংঘজননী রূপে সারদাকে অধিষ্ঠিত করা, উত্তরকালে সারদার নেতৃত্বে ত্যাগী সন্ন্যাসীদের রামকৃষ্ণ সংঘ-ভাব আন্দোলনের বহুমুখী প্রসারণ; সর্বোপরি, অগণন ভক্ত— অনুরাগীর জননীর দায়ভার গ্রহণ— এ সব কোনও আকস্মিক ঘটনা নয়। শ্রীমা সারদা আমৃত্যু যুক্তি-বুদ্ধি, সংস্কারমুক্ত চিন্তা-ভাবনা, বিবেক-বিবেচনা, মন-মনন এবং সহজাত মেধার সংযুক্তিতে যে ভাবে নিজেকে মেলে ধরেছিলেন তাতে আপন অবস্থানের ভূমিটি অনায়াসে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছে। ভূমি থেকে চিরকাঙ্ক্ষিত ভূমায় উত্তরণই ছিল তাঁর লক্ষ্য। সেই উত্তরণে ভূমি সংলগ্ন তাবৎ মানুষের সুখ-দুঃখের সংবেদনায় জগৎ জীবনের চলার পথটিতে প্রখর বাস্তববোধকে কখনওই কোনও ভাবেই অস্বীকার করেননি।
দক্ষিণেশ্বর নহবতের ছোট্ট ঘরটিতে থাকার সময় তিনি যেমন জপধ্যান করেছেন, তেমনই শাশুড়ি চন্দ্রমণিদেবীর সেবা করেছেন পরম নিষ্ঠাভরে। আবার শ্রীরামকৃষ্ণের জন্য জিওল মাছের ব্যবস্থা রেখেছেন। কাজ হয়ে যাওয়ার পর ‘ঝাঁটা’টিকেও সযত্নে রাখতে হয়। এর মধ্যেও সেই চিরন্তন দর্শন, ‘যাকে রাখো, সেই রাখে।’ ফলমূল পুজোর ভোগের জন্য নিয়ে যাওয়ার পর ছোট চুপড়িটিকেও সযত্ন ধুয়ে রাখতেন তিনি, যাতে অন্য কাজে ব্যবহার করা যায়। অন্যদেরও পরামর্শ দিতেন তা ফেলে না দিতে।
আধ্যাত্মিক জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত সারদা জটিল সামাজিক পারিবারিক জীবনে মানুষের সার্বিক উন্নতির কথা ভেবে প্রাধান্য দিয়েছেন কর্মযোগকে। কাজকর্ম বন্ধ করে শুধু জপধ্যান, পুজোপাঠ, সাধন ভজনের পক্ষে তিনি নন। এ সব তো আত্মনো মোক্ষর্থম্’। ‘জগদ্ধিতায় চ’ কাজ কে করবে? মানুষ বড় কাঁদছে। তার কান্না থামাতে হবে। আর সেই লক্ষ্যেই কাজ করতে হবে। প্রসঙ্গত স্মর্তব্য তাঁর দুটি জরুরি অভিমত: ক) ‘কাজ করবে না তো দিনরাত কী নিয়ে থাকবে? চব্বিশ ঘণ্টা কি ধ্যানজপ করা যায়?’ খ) ‘কাজ করা চাই বইকি। কর্ম করতে করতে কর্মের বন্ধন কেটে যায়। তবে নিষ্কাম ভাব আসে। একদণ্ডও কাজ ছেড়ে থাকা উচিত নয়।’
রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন, সারদা মঠ ও মিশনের সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীরা এবং এই ভাবধারার সংশ্লিষ্ট মানুষজন জপধ্যান পুজোপাঠ অপেক্ষা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, লাইব্রেরি-সংস্কৃতিকেন্দ্র-হাসপাতাল-দাতব্য চিকিৎসালয় পরিচালনা, দুর্গত মানুষের সেবা-ত্রাণ ইত্যাদি কাজকে প্রাধান্য দেন। রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের নির্দেশ ছিল এই কর্মযোগের সাধনার প্রতি। সারদা প্রখর বাস্তবতা আর আধুনিক দৃষ্টির সমন্বয়ে যে প্রজ্ঞা ও চৈতন্যের সন্ধান পেয়েছিলেন, তাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
বিরুদ্ধ পরিবেশকে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসা, তার সঙ্গে মানিয়ে চলার যে নমনীয়তা, তা আমরা সহজেই দেখতে পাই সারদার মধ্যে। স্বামী প্রকাশানন্দজি যখন সান ফ্রান্সিসকো কেন্দ্রে যাচ্ছেন তখন আমেরিকার সমাজ-পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তামগ্ন তাঁর প্রতি মাতৃ-আশীর্বাদ বর্ষিত হয়েছিল এই ভাবে— ‘যেখানে যেমন, সেখানে তেমন,’ ‘যখন যেমন তখন তেমন, যে যেমন তাকে তেমন।’ আমাদের শিক্ষা, তা সে পুঁথিগতই হোক কিংবা ব্যবহারিক, তার লক্ষ্যও কিন্তু সব পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া মানিয়ে চলা।
এই প্রসঙ্গে অনিবার্য ভাবেই এসে পড়ে সহনশীলতার কথাও। ভারতের চিরায়ত ধর্ম যে গ্রহিষ্ণুতা, সহিষ্ণুতা এবং আত্তীকরণের কথা বলে, রামকৃষ্ণ-সারদা-বিবেকানন্দ তাকে বিশেষ ভাবে প্রাধান্য দিতেন। সাম্প্রতিক কালে বহু ক্ষেত্রে এর বড় অভাব যখন আমরা লক্ষ করি, তখন ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-দর্শন বিঘ্নিত হওয়ায় মনে পড়ে না কি— ‘যে সয়, সে রয়, যে না সয় সে নাশ হয়।’ রামকৃষ্ণ-সারদার এই সাবধানবাণীকে আমরা কি মান্যতা দেব না?
আমাদের মনের গতি বিচিত্র। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত। তা আমাদের লক্ষ্যের দিকে পৌঁছতে দেয় না। তাই শ্রীমার পরামর্শ— বিশ্বাসের জায়গাটিকে ধীরে ধীরে পোক্ত করতে হবে। সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে নিজের। কিন্তু সমাজ সংসারে যাদের সঙ্গে থাকা, ওঠা-বসা তাদের যথাযথ মান দিয়ে ধৈর্যের সঙ্গে তাদের কথাও শুনতে হবে। আধুনিক জীবনে এ সবকেই আমরা ‘স্পেস’ দেওয়া বলে থাকি। সে কালেও তিনি একটু ‘আলগা দিয়ে’ সব দিক দূর থেকে লক্ষ করার কথা বলেছেন। যার যার স্বাধীনতা অধিকার তাকে তা দিতেই হবে, এটি তাঁর প্রবল অভিব্যক্তি।
আর বাস্তবের রক্ততটে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ নিরসনে শ্রীমা সারদা যে জগৎপ্লাবী নিদান দিয়ে গিয়েছেন, তা এ কাল, ভাবীকাল এবং চিরকালের জন্য অমোঘ সত্য— ‘যদি শান্তি চাও তবে... কারুর দোষ দেখো না... দোষ দেখবে নিজের। জগৎকে আপনার করে নিতে শেখো। কেউ পর নয়... জগৎ তোমার।’