ন’বছরের তফাতে একই বাঘ দেখা গেল সুন্দরবনে। নিজস্ব চিত্র
একটিই বাঘ নাকি সুন্দরবনে দীর্ঘ দশ বৎসর ধরিয়া বারংবার পর্যটকদের দেখা দিতেছে। গভীর অরণ্য ছাড়িয়া সে চলিয়া আসিতেছে নদী বা খাঁড়ির ধারে, অঙ্গ এলাইয়া পড়িয়া থাকিতেছে যথোচিত ভঙ্গিমায়। মানুষেও তাহাকে দেখিয়া শিহরিত হইতেছে, সেও মানুষের পানে তাকাইয়া সেই বিস্ময় ও সমাদর পোহাইতেছে। তবে কি এই অবলোকনসর্বস্ব যুগ, এবং নিজেকে বহু চক্ষু ও ক্যামেরার সম্মুখে অবলোকনের উপাদান হিসাবে মেলিয়া ধরিবার যুগ, বাঘকেও বাগে আনিল? ব্যাঘ্রের সহিত মানুষের সম্পর্ক বহু কালই নিবিড় ও পরিবর্তনশীল। প্রথম দিকে মানুষের স্থান হইত ব্যাঘ্রের উদরের মধ্যে। তাহার পর মানুষ আগ্নেয়াস্ত্র আবিষ্কার করিল এবং শুরু হইল শিকার ও শিকারির পালাবদলের পালা। ক্রমে মানুষের নির্বিচারে বন্যপ্রাণিহত্যা এমন পর্যায়ে পৌঁছাইল যে কিছু মানুষ আজ ব্যাঘ্র বাঁচাইবার জন্য অন্য মানুষের নিকট দরবার করে। ব্যাঘ্রেরা এই বিষয়ে সম্পূর্ণ অনবহিত থাকিবারই সম্ভাবনা, যেমন ব্যাঙ জানে না যে তাহার একটি লাতিন নাম আছে। কিন্তু এই তথ্যবিস্ফোরণের কালে, বলা যায় না, কিছু ব্যাঘ্র হয়তো জানিয়াছে যে, তাহাকে গুলি করিবার পরিবর্তে যত্ন করিবার প্রকল্প এই একদা-শত্রুগুলি লইয়াছে। কার্যকারণ না বুঝিলেও, উদ্দেশ্যটি মহৎ বলিয়াই ব্যাঘ্রসমাজে বিবেচিত হইবার সম্ভাবনা। তাই নিজের উদরে মানুষ পুরিবার পরিবর্তে মানুষের লেন্সে নিজেকে পুরিবার প্রকল্প ব্যাঘ্রের তরফ হইতে কৃতজ্ঞ উপঢৌকনও হইতে পারে।
যে বিশ্বে রিয়ালিটি শো এমন ভাবে জাঁকিয়া বসিয়াছে যে তাহাতে প্রায় নাট্যশাস্ত্র মানিয়া রোদন, উল্লাস, প্রতিযোগিতা হইতে ছিটকাইয়া গিয়া পুনরায় অলৌকিক প্রত্যাবর্তন এবং শেষ দৃশ্যে নায়কোচিত জয়লাভ সংঘটিত হয়, ক্রমেই সেই পৃথিবীতে বাস্তব ও নির্মিত বাস্তব গুলাইয়া যায়। যে অনাথ প্রতিযোগী সহস্র আলাকবৃত্তে দাঁড়াইয়া রোদন করিতেছে, সে নিজেও সর্বদা বুঝিতে পারে না, টিআরপি-র জন্য কাঁদিতেছে না মৃত বাবার কথা ভাবিয়া? ব্যাঘ্রটিও হয়তো তাহার এই মনুষ্য-আকর্ষণের কেন্দ্রস্থলে থাকিবার সময়টুকুকেই শ্রেষ্ঠ শার্দূলমুহূর্ত হিসাবে, সার্থক ব্যাঘ্রতা হিসাবে ভাবিতেছে। সে কি বুঝিতে পারিতেছে, এই দেখনদারির ফলে সে মানুষের চূড়ান্ত অধীন হইল? বারুদ দিয়া যে বাঘকে জয় করা হইত, সে মরিত বীর প্রতিদ্বন্দ্বীর ন্যায়। যে বাঘ স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে এক দশক ধরিয়া মানুষের বিনোদনের অঙ্গ হিসাবে নিজেকে মেলিয়া ধরিতেছে, সে যে ক্ষমতাবান প্রজাতির নিকট কিছু অতিরিক্ত নতি স্বীকার করিল, সেই জ্ঞান তাহার আছে?
বন্যপ্রাণী মানুষের অধীন হইয়াছে বটে, কিন্তু স্বেচ্ছায় নিজ আবডাল ভাঙিয়া পর্যটকদের তুষ্টিসাধনের দীনতা, মর্যাদাচ্যুতি তাহাকে স্পর্শ করে নাই। যদি একটি ব্যাঘ্র সেই কাজ করে, তবে ব্যাঘ্রসমাজে তাহার জাত যাওয়া স্বাভাবিক। যদি না বহু ব্যাঘ্র মিলিয়া পরামর্শ করিয়া এই ব্যাঘ্রটিকে এই বিশেষ চাকুরিতে নিযুক্ত করিয়া থাকে। মূর্খগুলিকে ঘুরিয়াফিরিয়া তুই দেখা দিবি, তাহা হইলেই উহারা ভাবিবে বহু বাঘ আসিতেছে, তাই এই পর্যটনযোগ্য স্থানটির অধিক উন্নয়ন আবশ্যক। উন্নীত স্থানে আমরা অসচেতন যাত্রী বা মধু-শিকারি অধিক পাইব ও গপাগপ খাইব। তাহা সত্য হইলে অবশ্য, সময় গড়াইলে কে কাহাকে দেখিয়া লইবে, বলা দুষ্কর।