তিন তালাক প্রথা সুপ্রিম কোর্ট যে রদ করেছে, তাতে আমরা খুশি। কিন্তু এটাও আমাদের কাছে স্পষ্ট যে এতে পুরুষতন্ত্রে একটা ঘা দেওয়া গিয়েছে মাত্র। এর ফলে যে মেয়েরা সমানাধিকার পেল, এমন মনে করলে ভুল হবে। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, ইসলাম ধর্ম অনুসারে তিন তালাক গ্রহণযোগ্য নয়, তাই একে বাতিল করা হল। কিন্তু এর পরেও তালাক, বা অন্য যে কোনও বিষয়ে মুসলিম মেয়েদের বিচার চাইতে গেলে মুসলিম পারিবারিক আইনের অধীনেই তা চাইতে হবে। সমস্যা হল, পারিবারিক আইন মেয়েদের সমান অধিকার দেয়নি। এখনও মেয়েদের তালাক দেওয়ার অনুমতি নেই, কেবল পুরুষদেরই আছে। মেয়েরা শুধুমাত্র তালাক চাইবার অনুমতি নিতে পারে, যার নাম ‘খুলা’। কিন্তু এখানেই আমাদের প্রশ্ন হল, এই বৈষম্য থাকবে কেন? জন্মসূত্রে একটি পুরুষ তালাক দেওয়ার অধিকার পায়, মেয়েরা তা কখনওই পায় না। এক জনের হাতে বিচ্ছেদের ক্ষমতা থাকবে, অন্য জন অপেক্ষা করবে তা পাওয়ার জন্য, এটা সমানাধিকার হতে পারে না। তালাকে পুরুষদের যতটা অধিকার, মেয়েদেরও ততটাই।
সেই রকম, ‘হালালা’ প্রথাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া চলবে না। এর ফলে কোনও পুরুষ রাগের মাথায় তালাক দেওয়ার পর ফের স্ত্রীকে ফেরত নিতে চাইলেও তার উপায় থাকে না। মেয়েটিকে আবার নিকাহ্ করে, তালাক নিয়ে, তার পর আগের স্বামীকে বিয়ে করতে হয়। এ তো একটা বর্বরোচিত প্রথা। কোনও বিধিনিয়মই একটি মেয়েকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে ও সহবাস করতে বাধ্য করতে পারে না।
সেই রকমই আমরা চাই, পুরুষের বহুবিবাহের অধিকার বন্ধ হোক। এটা শুধু যে সমানাধিকারের বিরোধী কেবল তা-ই নয়, এক জন পুরুষকে কেন্দ্র করে যখন তিন-চার জন মহিলা জীবনযাপন করতে বাধ্য হন, তা কখনওই সুস্থ পরিবেশ তৈরি করে না। মেয়েদের অমর্যাদা, নির্যাতন ও বঞ্চনার ক্ষেত্রে প্রস্তুত হয়েই থাকে। অনেক ইসলামিক দেশে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ (তুর্কি) বা নিয়ন্ত্রিত (পাকিস্তান, বাংলাদেশ) হয়েছে। ভারতেই বা তা হবে না কেন?
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সম্পত্তির সমানাধিকার। হিন্দু পারিবারিক আইন বদল করে মেয়েদের বাবার সম্পত্তি, স্বামীর সম্পত্তিতে সমান অধিকার সুরক্ষিত করা হয়েছে। ইসলাম মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার দিয়েছে, কিন্তু সমানাধিকার দেয়নি। তা ছাড়াও, শ্বশুরমশাইয়ের জীবদ্দশায় যদি কোনও মহিলার স্বামী মারা যান, তা হলে শ্বশুর পুত্রবধূকে ও তাঁর সন্তানদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে পারেন। পাকিস্তান ও বাংলাদেশে এই নিয়ম রদ করার জন্য আইন হয়েছে, কিন্তু ভারতে আজও তা হয়নি।
একটা জিনিস আমরা লক্ষ করি যে, ভারতের মুসলিমরা যে সব বিষয়ে ইসলামিক বিধি মেনে চলেন, এমন নয়। ইসলাম ধর্মে সুদ দেওয়া-নেওয়া নিষিদ্ধ। কিন্তু ভারতে মুসলিমরাও ঋণে সুদ দিই, সঞ্চয়ের উপর সুদ নিই। জীবন-জীবিকার প্রশ্নে যখন আমরা দেশের আইন মানতে পারি, তখন শুধু মুসলিম মেয়েদের কেন মুসলিম সম্প্রদায়ে রেখে বিচার করা হবে? এই বৈষম্য কেন?
আমরা দেখেছি, বিবাহ-বিচ্ছেদের পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করা হয় যে, তালাক অত গুরুতর সমস্যা নয়। হিন্দুদের চাইতে মুসলিমদের মধ্যে বিচ্ছেদের হার কম, এমন বোঝানো হয়। সত্যিই ওই হার কম কি না, তা বোঝার উপায় নেই, কারণ তালাকের রেজিস্ট্রেশন হয় না। কিন্তু যদি ধরেও নেওয়া যায় যে তালাকের হার কম, তাতে সমস্যা কিছু কমছে না। তালাকের পদ্ধতি নিয়ে আমাদের প্রশ্ন। আমাদের দাবি, পারিবারিক আইনকে সংস্কার করে তালাকের একটা লিখিত ‘কোড’ তৈরি করতে হবে, এবং আদালতে তা নথিভুক্ত করলে তবেই তালাক বৈধ হবে। সংস্কার করতে হবে এই লক্ষ্য নিয়ে, যাতে মেয়েরা পুরুষের সঙ্গে সমান হয় মর্যাদায় এবং অধিকারে।
তিন তালাক রদ হওয়া যথেষ্ট নয়। তালাক দেওয়ার একপেশে ক্ষমতা মেয়েদের জীবনে কী সংকট আনছে তা বোঝা যায়, যখন শোনা যায় সেই মেয়েদের কথা, যাদের তালাক দেওয়া হয়েছে, যাদের তালাক না দিয়েই তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যারা একাধিক সপত্নীর সঙ্গে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে। সন্তানদের মুখ চেয়ে সেই মেয়েদের কেমন জীবন বাঁচতে হচ্ছে। এর পর যখন দেওবন্দ থেকে ফতোয়া আসে যে, দাম্পত্য হল শিসা (কাচ) আর তালাক হল পাথর, পাথর ছুড়লে শিসা ভাঙবেই, তখন তার অন্যায়টা বোঝা যায়। মেয়েদের মত না নিয়ে, হঠাৎ তালাক দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পর মেয়েরা যখন পুলিশের কাছে যায়, তখন থানা থেকে বলে দেওয়া হয় ‘ওটা তোমাদের ব্যাপার।’ আইনের কাছে কোনও সহায়তা মেয়েরা পায় না। তালাকের যথাযথ পদ্ধতি নিশ্চিত করতে পারলে মেয়েরা পুলিশ-প্রশাসনের সহায়তা থেকে বঞ্চিত হবে না।
হিন্দু পারিবারিক আইন যে ভাবে কোডিফাই করা হয়েছে, সে ভাবে মুসলিম পারিবারিক আইনকেও কোডিফাই করতে হবে। আর তা করবে রাষ্ট্র। এ আমাদের দীর্ঘ দিনের দাবি। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর তা আরও জোরদার হল। তবে দায়িত্ব বাড়ল অধিকার-আন্দোলনের কর্মীদেরও। আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে তালাকের (বিবাহ-বিচ্ছেদের) আইন কোডিফাই করার সময় কোনও মৌলবাদের বা পুরুষতান্ত্রিক আইনের প্রভাব না পড়ে।
সুরেন্দ্রনাথ কলেজ ফর উইমেন-এ বাংলার শিক্ষক