শেষ পর্যন্ত শাস্তিস্বরূপ পাকিস্তানের টাকা কাটিয়া লওয়া হইল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দেশ পাকিস্তানকে ‘সন্ত্রাসবাদের লীলাভূমি’ নাম দিয়া ঘোষণা করিল যে, পাকিস্তানকে তাহার দেয় অর্থের বেশ খানিক অংশ অতঃপর দেওয়া হইবে না। কেননা, অনেক প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও পাক সরকার জইশ-এ-মহম্মদ, লস্কর-এ-তইবার মতো জঙ্গি সংগঠনগুলির বিরুদ্ধে কঠোর হয় নাই, তাহাদের শাখা সংগঠনগুলি এখনও ওই দেশে প্রকাশ্যে সক্রিয়। মার্কিন বিদেশ মন্ত্রকের বার্ষিক রিপোর্ট অভূতপূর্ব রকমের কঠোর ভাষায় পাকিস্তানি রাষ্ট্রের সমালোচনা করিয়াছে। অনেক কড়া কথা বলিয়াও শেষ অবধি পাক সরকারের প্রতি সহানুভূতি রাখাই ওয়াশিংটনে চালু রীতি ছিল, কিন্তু এ বার টাকাও কাটিয়া লওয়া হইল। এই রীতিভঙ্গকে আকস্মিক বলা যায় না। নির্বাচিত হইবার পরই ট্রাম্প নির্মম ভাষায় পাকিস্তানের প্রতি উষ্মা দেখাইয়াছিলেন। বলিয়াছিলেন, যে ‘মিত্র’ দেশ ওসামা বিন লাদেনের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভয়ংকর ‘শত্রু’কে ছয় বৎসর ধরিয়া আশ্রয় দিতে পারে, তাহার ‘মিত্রতা’ পুনর্বিবেচনাই তাঁহার লক্ষ্য। কয়েক মাস ধরিয়া পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান লইবার কথা বলিয়া আসিতেছিল ট্রাম্প প্রশাসন, যদিও মার্কিন কূটনৈতিক প্রতিষ্ঠানের একাংশ তাহাতে একমত ছিল না। এই বিরুদ্ধবাদীদের মত: পাকিস্তানের প্রতি কঠোর হইলে আখেরে জঙ্গিদের লাভ, আমেরিকার ক্ষতি। সুতরাং সাম্প্রতিক রিপোর্টে পাকিস্তানের সন্ত্রাস-লীলাভূমি অভিধাটি, নিশ্চিত ভাবেই, ট্রাম্প শিবিরের জয়, এবং মার্কিন কূটনীতির প্রচলিত রীতির ব্যত্যয়।
ওয়াশিংটন ডিসি-র কাছে পাকিস্তান অনেক দিনই একটি বিরাট প্রহেলিকা, না বুঝিয়াই যাহার প্রতি সাহায্যের দীর্ঘ হাত বাড়াইয়া রাখিতে হইয়াছে। হিংস্রতম সন্ত্রাসবাদ সে দেশে অবিরত জন্ম লয়, কিন্তু পাকিস্তানের ঘোর শত্রুরও বিশ্বাস যে, পাকিস্তানের পুরোটা একই রকম নয়। তাহার ভিতরে যেমন বহু বিপজ্জনক জঙ্গি গোষ্ঠীর প্রস্ফুরণ, তেমনই আবার আর একটি পক্ষ নিজেদের নিরাপত্তার কারণেই সেই জঙ্গিপনার সঙ্গে ক্রমাগত যুঝিতেছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের আমলে সন্ত্রাসদমনের লক্ষ্যে অনেক কাজ হইয়াছে। তাই, এক কালের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী পাকিস্তান এখন ওয়াশিংটন হইতে অনেকটা দূরে সরিয়া গেলেও মার্কিন কূটনীতিকদের অনেকেই ভোলেন নাই যে, পাকিস্তানের ভিতরের বিপদটির মোকাবিলার জন্য সর্বাপেক্ষা বেশি জরুরি পাকিস্তানেরই সহায়তা। ইসলামাবাদের নিজের উদ্যোগ এবং প্রয়াস ব্যতীত সে দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবিষ্ট সর্পিল বিপদের হদিশ পাওয়াই হয়তো বাহিরের লোকের পক্ষে অসম্ভব দাঁড়াইবে।
আপাত ভাবে এই প্রহেলিকা ঘুচাইয়া স্পষ্টতার আলোকে উদ্ভাসিত হইতে চাহিতেছে ট্রাম্প প্রশাসন। ইহাই তাহার বিশিষ্ট কর্মপদ্ধতি। কাতারের ক্ষেত্রেও দেখা গিয়াছে— ‘কূট’ নীতির অপেক্ষা শাস্তি ও নিষেধাজ্ঞার ‘সরল’ নীতিতেই ট্রাম্প প্রশাসনের বিশ্বাস। এই নবপ্রণীত নীতি কতখানি কার্যকর হইবে, এখনই বলা মুশকিল। তবে ভোলা যাইবে না যে, আর একটি মিত্র দেশের সমমনস্ক সরকারের সমর্থনও ট্রাম্প সরকারের যুযুধানতার পিছনে বড় ভূমিকা পালন করিতেছে। নরেন্দ্র মোদীর সাম্প্রতিক মার্কিন সফরে পাকিস্তান প্রসঙ্গে যে যুগ্ম বক্তব্য পেশ হইল, তাহার ভাষা ও বক্তব্যও কিন্তু নজিরবিহীন ভাবে কঠোর ছিল। লক্ষণীয়, মার্কিন হুমকির সংবাদের অব্যবহিত পরে পরেই ভারতের উপরাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী, প্রধানমন্ত্রীর প্রীতিধন্য বেঙ্কাইয়া নায়ডু পাকিস্তানকে সন্ত্রাসে মদত দিবার অভিযোগে বিদ্ধ করিলেন। উপরাষ্ট্রপতি হইবার ঠিক আগেই এত চড়া সুরে প্রতিবেশী দেশকে নিশানা করা রীতি-সম্মত নহে। তবে, হুমকি-কূটনীতির খেলায় কে-ই বা কবে রীতির তোয়াক্কা করিয়াছেন!