সোশ্যাল মিডিয়ার দুই মুখ

এই ভাবে উঠে আসা অর্থ এবং ত্রাণসামগ্রীর পরিমাণ নগণ্য নয়। ভারতে এ রকম বেশ কিছু উদাহরণ আছে যেখানে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সমাজ এবং দেশের মঙ্গল হয়েছে।

Advertisement

তাজুদ্দিন আহ্‌মেদ

শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

কেরলের সাম্প্রতিক বন্যার সময় সোশ্যাল নেটওয়ার্ক জুড়ে ছিল ত্রাণকার্যে সাহায্যের অনুরোধ এবং কী ভাবে সেই সাহায্য বন্যাদুর্গতদের কাছে যাবে, সে বিষয়ে নির্দেশ এবং আলোচনা। বহু মানুষ সেই অনুরোধে সাড়া দিয়েছেন। এই ভাবে উঠে আসা অর্থ এবং ত্রাণসামগ্রীর পরিমাণ নগণ্য নয়। ভারতে এ রকম বেশ কিছু উদাহরণ আছে যেখানে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সমাজ এবং দেশের মঙ্গল হয়েছে।

Advertisement

এই সব উদাহরণ এক দিকে যেমন নতুন আশার সঞ্চার করে, অন্য দিকে সোশ্যাল মিডিয়ার নেতিবাচক রূপটি আমাদের আশঙ্কিত করে। ব্যক্তি এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষবিষ ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে প্রযুক্তির এই ফসলগুলি। প্রাচীন রোমের দ্বিমুখী দেবতা জানুস যেমন এক দিকে অতীত, অন্য দিকে ভবিষ্যতের দিকে তাকাতেন, তেমনই এক অঙ্গে দুই বিপরীত রূপ বহন করা সোশ্যাল মিডিয়া কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করে। প্রথমত, সোশ্যাল মিডিয়া কি আজ নতুন গণপরিসর হিসেবে প্রথাগত ভাবে স্বীকৃত গণপরিসরের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে? দ্বিতীয়ত, গণপরিসরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ার বিস্তার কতখানি এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে অতীতের গণপরিসরের চেয়ে এটি কী ভাবে আলাদা? তৃতীয় প্রশ্নটি হয়তো সব চেয়ে প্রয়োজনীয়— গণতন্ত্র তথা সামাজিক সুস্থিতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে গণপরিসরের দায়িত্ব কি পালিত হচ্ছে তার এই নতুন অবতারে?

সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকের ইউরোপে আধুনিক রাষ্ট্র এবং পুঁজিনির্ভর অর্থনীতির বিকাশের সঙ্গে রাষ্ট্রের এক্তিয়ারের বাইরে যুক্তিসঙ্গত বিতর্কের একটি পরিসর তৈরি হয়েছিল। কফি হাউস, সালোঁ, টেবল সোসাইটি, ব্যবসায়ীদের জমায়েত, পরবর্তী কালে সংবাদপত্র এবং পত্রপত্রিকার পাতা— এই পরিসরে যুক্তিসঙ্গত আলোচনা এবং তর্কবিতর্কের মাধ্যমে উঠে আসা মতামত রাষ্ট্রের সমালোচনার পাশাপাশি রাজনীতি এবং অর্থনীতিকে দিশা দেওয়ার চেষ্টা করত। কিছুটা পরিবর্তিত প্রকারে এই গণপরিসর ভারতেও ছিল। কিন্তু অধুনা ক্যান্টিন, কফিহাউস, আড্ডা, আলোচনা, সংবাদমাধ্যমের বিতর্ক, এই সব প্রচলিত এবং প্রতিষ্ঠিত পরিসরের সঙ্গে যোগ হয়েছে অতিসক্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া। বিনোদন এবং সামাজিক যোগাযোগের জন্য মূলত ব্যবহৃত হলেও অজস্র ভার্চুয়াল গোষ্ঠীর সৌজন্যে তথ্য ও মতামত স্রোতের মতো আসতে থাকে এবং বহু মানুষ সত্যমিথ্যা যাচাই না করেই তার দ্বারা প্রভাবিত হন। তাই, দেশের ৬৫ শতাংশ মানুষের কাছে উন্নত প্রযুক্তির স্মার্টফোন না থাকলেও, গণপরিসর হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষত নেটওয়ার্কিং সাইটগুলির গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায় আর নেই। প্রথম প্রশ্নের উত্তরে তাই বলা যেতে পারে যে গণপরিসরের অল্প কিছুটা অংশ এই সব ভার্চুয়াল মাধ্যমের দখলে থাকলেও, সেগুলি থেকে উঠে আসা কণ্ঠস্বর এবং মতামত আজ সব চেয়ে তীব্র ভাবে শ্রুতিগোচর।

Advertisement

তত্ত্ব বলবে, ব্যক্তিগত এবং সর্বজনীন পরিসরের সীমানা মুছে যেতে শুরু করলে এবং গণপরিসর আয়তনে বৃদ্ধি পেলে সেই পরিসর তার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হারিয়ে দুর্বল হয়। যে গণপরিসরের অংশ হিসাবে সোশ্যাল মিডিয়া বর্তমান সময়ে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, সেটি অতীতের তুলনায় একটি দুর্বলতর পরিসর। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর হিসেবে বলা যেতে পারে যে অতীতের অর্থাৎ বুর্জোয়া গণপরিসরের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য— যুক্তিসঙ্গত বিতর্ক— বর্তমান এই পরিসরে প্রায় অনুপস্থিত। এবং এই অনুপস্থিতি গণপরিসরের অন্য সব উপকরণের চেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকাতে সব চেয়ে বেশি প্রকট। এখানে গঠনমূলক বিতর্কের জায়গা নিয়েছে প্রশংসা, তারিফ বা সেগুলির অনুপস্থিতি ও বিরোধিতা।

তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর নিহিত রয়েছে যুক্তিসঙ্গত বিতর্কের অনুপস্থিতির মধ্যেই। এই অনুপস্থিতি এক দিকে যেমন গণপরিসরের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চরিত্রকে দুর্বল করেছে, অন্য দিকে সেটিকে রাষ্ট্র এবং বৃহৎ কর্পোরেট ও রাজনৈতিক শক্তিগুলির বিজ্ঞাপন ও পেশি আস্ফালনের ক্ষেত্র করে তুলেছে। ব্যক্তির মত যদি এই বৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে যায়, তবে শুরু হয় আক্রমণ। ট্রোলিং ও অন্যান্য সাইবার অপরাধ ভারতে তাই নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এর সঙ্গে রয়েছে অসত্য এবং অর্ধসত্যকে বৈধতা দানের এক নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী রামকৃষ্ণ মিশনে কী ভাবে দীক্ষা নিয়েছেন, সে গল্প যখন সোশ্যাল মিডিয়াতে ডালপালা মেলে, তখন বিশ্বাস না করে উপায় থাকে না। বৈদিক যুগের ভারতে চিকিৎসাশাস্ত্র যে আধুনিক অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার চেয়ে কোনও অংশে কম ছিল না, সেই মত একটার পর একটা মনগড়া উদাহরণ নিয়ে হাজির হয় এবং এক ধরনের বৈধতা আদায় করে। আবার মর্ফ করা ছবি এবং সত্যমিথ্যা মেশানো তথ্যের সাহায্যে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সব মানুষই যে সন্ত্রাসবাদী সেই মতকে প্রতিষ্ঠা করা হয়।

ইউরোপে গণপরিসরে যুক্তিনিষ্ঠ বিতর্কের মধ্য দিয়ে উঠে আসত মতামত। আজকের ভারতে মতামত (সাধারণত সংখ্যাগুরু সমর্থিত) প্রথম থেকেই বিদ্যমান। গণপরিসরের মাধ্যমে সেটিকে বৈধতা দেওয়া হয় এবং বিরোধীদের চিহ্নিত করে আক্রমণ করা হয়। এই প্রক্রিয়া অনুসৃত হয় ভারতের গণপরিসরের সব ক’টি অংশেই। কিন্তু অবয়বহীন হওয়ার দৌলতে সোশ্যাল মিডিয়ায় এই প্রক্রিয়া সহজেই পৌঁছেছে তার শিখরে।

(আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির শিক্ষক)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন