শান্তিনিকেতনের ‘আনন্দবাজার’: যথার্যই আনন্দযজ্ঞ

ঝলমল শরতের সোনালী সকাল থেকেই গৌরপ্রাঙ্গণে দোকান সাজানোর তুঙ্গ ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায় কচিকাচা থেকে বড় ছাত্র-ছাত্রীদের। দুপুর গড়ালেই সবাই নিজেদের অভিনব পসরা নিয়ে ব্যস্ত, তাদের আবদারের ক্রেতাদের ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি করতে। লিখছেন সুকুমার দাস।‘আনন্দবাজার’ ব্যাপারটা রবীন্দ্রনাথের বিদেশিকে স্বদেশি করার আর একটি দৃষ্টান্ত— ‘... একটা সৎকাজে টাকা তোলার জন্য আট আনার জিনিস আটষট্টি টাকায় বিক্রি হয় একদিনের বিলাসী মেলায়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০১:০৪
Share:

বিশ্বভারতীর পড়ুয়াদের শিল্পকর্ম নিয়ে গৌরপ্রাঙ্গণে আনন্দমেলা। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

প্রতি বছর এক অন্য স্বাদের মেলা হয় শান্তিনিকেতনে। আর কোনও মেলার সঙ্গে উদ্দেশ্যের দিক থেকে তত্ত্বগত মিল নেই, এমন এক মেলা হল শান্তিনিকেতনের ‘আনন্দমেলা’। শতবর্ষ আগে শান্তিনিকেতনের এই বৈচিত্র্যপূর্ণ আনন্দানুষ্ঠানের নামকরণ হয়েছে ‘আনন্দবাজার’। যার মূলে রয়েছে ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাস’। সৃষ্টি আর কর্মের মেলবন্ধনেই আনন্দের জয়গান করতে এই উৎসব সূচিত হয়েছিল এক দিন। ‘আনন্দবাজারে’র বিচিত্র ধারা, পদ্ধতি এবং চরিত্র দেখে যে সত্যটি মনে জাগে, তা হল, সময় যতই অল্প হোক, সামর্থ্য যতই কম থাকুক, আয়োজন যতই স্বল্প হোক না কেন, জীবনকে উপভোগ করার আগ্রহ থাকলেই সেই আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায়।

Advertisement

সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরী এক সময় শান্তিনিকেতনের এই ‘আনন্দবাজার’-এর উৎস খোঁজার চেষ্টা করেন। এক অভিনব উপলব্ধি তাঁর হয়েছিল। তাঁর মতে, বিদেশে ‘ফেট’ নামে এক উৎসবের মতোই এখানকার এই ‘আনন্দবাজার’ বা ‘আনন্দমেলা’। ‘আনন্দবাজার’ ব্যাপারটা রবীন্দ্রনাথের বিদেশিকে স্বদেশি করার আর একটি দৃষ্টান্ত— ‘... একটা সৎকাজে টাকা তোলার জন্য আট আনার জিনিস আটষট্টি টাকায় বিক্রি হয় একদিনের বিলাসী মেলায়। মেলার অন্তে লাভের টাকা সৎকাজে খরচ করার মূল নীতিটুকু কিন্তু একই আছে।’ (রবীন্দ্রজীবনী: ২য় খণ্ড, পৃ. ২০৫) আনন্দমেলার মাধ্যমে গরিব-দুঃস্থ, অসহায় ছাত্রছাত্রীদের সহায়তাদান কার্যটি শান্তিনিকেতনে শতাব্দীকাল ধরে আজও অক্ষুণ্ণ রয়েছে।

‘আনন্দবাজার’-এর আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়েছিল ১৯১৫ সালে ১৫ এপ্রিল, বাংলা নববর্ষের দিনে। প্রথম দিকে নববর্ষের দিন, পরে পৌষমেলা শুরুর আগের দিনও মেলার দিন ধার্য ছিল। বর্তমানে পুজোর ছুটির প্রাক্‌লগ্নে এক পক্ষকাল ব্যাপী শারদোৎসবের নাটক-পালা শেষ হলে, পরের দিন মহালয়ার পুণ্য তিথিতে গৌরপ্রাঙ্গণে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মাত্র কয়েক ঘণ্টার একটি মেলা, কিন্তু প্রস্তুতি চলে বেশ কিছুকাল ধরে। মাসখানেক আগে থেকেই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এক একটা ক্লাস, সেকশন বা দলে-উপদলে ভাগ হয়ে প্রায় প্রতিনিয়ত শলাপরামর্শ চলতে থাকে। তার পরেও কিসের দোকান দেওয়া হবে, তার জন্য কী কী উপকরণ কী উপায়ে সংগৃহীত হবে, দোকান করার জন্য আবেদনপত্র কী ভাবে কোথায় কার হাতে জমা দিতে হবে, কী পরিমাণ চাঁদা সংগৃহীত হবে, অভিভাবকেরা কে কী ভাবে সাহায্য করতে পারেন— এসব নিরন্তর প্রশ্ন ছেলে-মেয়েদেরকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে।

Advertisement

সামগ্রিক আয়োজনে সহায়তা করে বিশ্বভারতীর সারা বছরের উৎসব-অনুষ্ঠানের ধারক ও বাহক— শান্তিনিকেতন-কর্মিমণ্ডলী। ঝলমল শ3wরতের সোনালী সকাল থেকেই গৌরপ্রাঙ্গণে দোকান সাজানোর তুঙ্গ ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায় কচিকাচা থেকে বড় ছাত্র-ছাত্রীদের। দুপুর গড়ালেই সবাই নিজেদের অভিনব পসরা নিয়ে ব্যস্ত, তাদের আবদারের ক্রেতাদের ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি করতে। মেলায় থাকে নানাবিধ শিল্পকর্ম, হরেক রকমারি খাদ্যসম্ভার, তাৎক্ষণিক কবিতা লেখা কিংবা ছবি আঁকা, রংবেরঙের গৃহসজ্জার ছোট ছোট উপকরণ, ছোটদের খেলনা, ম্যাজিক, লটারি খেলা, জ্যোতিষ, পুতুল খেলা আর ঢাক কাঁসির নিরন্তর উত্তেজনা, আরও কত কী! খাবারের দোকানে চা-কফি, ঘুগনি, চপ-পেঁয়াজি, মিষ্টি-পিঠে হুহু করে বিক্রি হয়ে যায়। বলা প্রয়োজন যে, এই মেলায় ক্রেতার পরিসরটি কম নয়। উপাচার্য বা কর্মসচিব মশাই থেকে শুরু করে সব শ্রেণির অধ্যাপক-আধিকারিক, শিক্ষাকর্মী থেকে পড়ুয়ারা নিজেরাও ক্রেতা। আবার আবাসিক পড়ুয়াদের অভিভাবক, যাঁরা সেদিন তাঁদের সন্তানদের পুজোর ছুটিতে হস্টেল থেকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য আসেন— তাঁদেরও প্রায় সিংহভাগ। এ ছাড়াও স্থানীয় মানুষজন তথা আশ্রমিক সমাজ, সব মিলে কয়েক হাজার ক্রেতা এই আনন্দ-যজ্ঞে শামিল হন। দোকানের নামের সঙ্গে জিনিসপত্রের নামের বৈচিত্র্য ক্রেতাদের আকর্ষণের অন্যতম কারণ। চা-কফির নাম হয় আনন্দধারা, অমৃতধারা বা সোমরস। সিঙ্গারার নামকরণ হয় ত্রিশৃঙ্গধারিণী। মুখরোচক এখানে আকার নেয় ‘মুরোখচক’ ইত্যাদিতে।

রবীন্দ্রনাথ নিজে একবার চার আনা দামের রুমাল এক টাকা দিয়ে কিনেছিলেন। আশ্রমের পুরনো দিনের ছাত্র প্রমথনাথ বিশীরা ১৯২৯ সালে এক ঐতিহাসিক প্রদর্শনীর দোকান খুলেছিলেন। সেখানে ‘রামের খড়ম, সীতার চিরুনি, চণ্ডীদাসের হস্তাক্ষর’ প্রভৃতি বিস্ময়কর জিনিস ছিল। বাস্তবিকই সেই প্রদর্শনী ছিল নিতান্ত কৌতূকের বিষয়। ‘রামের খড়ম’ বলতে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের চটি-জুতোকে বোঝানো হয়েছে, সীতাদেবী হলেন তাঁর কন্যা— তাঁর চিরুনির কথা বলা হয়েছে। আর চণ্ডীদাস নামে তখন পাকশালায় এক পাচক কাজ করতেন, তাঁর হাতের লেখা সেই প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছিল। তাই দশর্ক সাধারণ একেবারে হতাশ হননি। ১৯২৬-এ এ রকমই এক প্রদর্শনীতে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং ঢুকে পড়েছিলেন। দেখলেন, ছাত্রেরা এক টুকরো কাগজে কিছুটা ধুলো রেখে, বিজ্ঞাপিত করে বলছিল ‘সীতাদেবীর ধূলা’। মেলা থেকে ফিরে এসে রবীন্দ্রনাথ সীতাদেবীকে বলেছিলেন ‘সীতা ওখানে তোমার চরণরেণু দেখে এলাম।’

অমিতা সেন স্মৃতিচারণা করেছেন— ‘একবার আশ্রমের আনন্দবাজার উৎসবের দিনে নন্দলাল বসুর স্ত্রী সুধীরা দেবী নানা রকমের ফুলের গয়না করে একটি চাকডালাতে সাজিয়ে মেলায় পাঠিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তা দেখে বিস্ময়ে মুগ্ধ হয়ে চাকলা সুদ্ধু সব গয়না কিনে নিয়ে মেয়েদের সবাইকে ভাগ করে দিলেন।’ এ ছাড়াও অনেক বিস্ময়কর পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন হত। এ ছাড়াও দেখা যায়, কার্ড বোর্ডে আঁকা বিভিন্ন জন্তু জানোয়ারের ছবির মধ্যে ঢুকে আনন্দ দিচ্ছে কলাভবনের ছাত্র-ছাত্রীরা। কিছু ছাত্র ‘জোকার’ সেজে লোক ডাকে। হাতে আঁকা কার্ড, পুরনো ব্যাটারি, ডিমের খোলা, ভাঙা শিশি দিতে তৈরি খেলনাও বিক্রি হয়। দেবদারু, সন্ধ্যামণি প্রভৃতির বীজ দিয়ে মালা, কানের দুলের ভাল চাহিদা। পাঠভবনের ছাত্রসম্মিলনী নানা পসরা নিয়ে বেচাকেনা করে। এখানে ‘শিল্পীকোণ’ বা ‘কবিকোণ’ বিশেষ ভূমিকা নেয়। ক্রেতা বা দর্শক গিয়ে দাঁড়ালে সঙ্গে সঙ্গে তাঁর একটি ছবি এঁকে বা তাঁর নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করে মুহূর্তের মধ্যে একটি কবিতা লিখে ক্রেতা-দর্শকের হাতে ধরিয়ে বিশ, পঞ্চাশ টাকা চাইলে যে কেউ খুশি হয়ে দিয়ে দেন।

সেই পুরনো ধারাকে বজায় রেখে আজও এই আনন্দানুষ্ঠানের মাধ্যমে এক সঙ্গে অনেক সদর্থক উদ্দেশ্য সাধিত হয়। শনিবারও সেই আনন্দমেলা হয়ে গেল বিশ্বভারতীতে। কবি মনে প্রাণে অনুভব করতেন, শিশু কিশোরদের মানবিক পূর্ণ বিকাশ কেবল অধ্যয়নের মাধ্যমে সম্ভব নয়। সহজ সরল প্রাকৃতিক উপায়ে সৃজনশীলতা বা বিনোদন চর্চার একান্ত প্রয়োজন। এটি একেবারেই বিশ্বভারতীর পড়ুয়াদের নিজস্ব মেলা। বাইরের কেউ দোকান দেওয়ার অনুমতি পান না। কারণ লভ্যাংশ ছাত্র-ছাত্রীদের কাম্য নয়, তারা সবটাই জমা করে বিশ্বভারতীর দরিদ্র-ভাণ্ডার সেবা শাখার তহবিলে।

শিশু-কিশোরদের কল্পনার বিকাশ ও উদ্ভাবনী শক্তির প্রকাশে এই মেলা যেমন সহায়ক, তেমনই লাভ-ক্ষতির টানাপড়েন তাদেরকে ভবিষ্যৎ জীবনে সচেতন হতে শেখায়। এ ছাড়াও রুচিবোধ, চরিত্র গঠন এবং ছোট-বড় সবার সঙ্গে অকপটে মিশতে শেখা, সকলকে বিশ্বভারতীর ভাবাদর্শের মতোই এক মিলন মন্ত্রে দীক্ষিত হওয়ার সুযোগ করে দেয় এই ‘আনন্দবাজার’।

লেখক বিশ্বভারতীর রবীন্দ্র-গবেষক ও গ্রন্থাগারকর্মী, মতামত নিজস্ব

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন