অর্থনীতির ঘাড়ে রাজনীতিকে চাপিয়ে দিলেই আর প্রশ্ন থাকে না

প্রতিশ্রুতির চার বছর

নরেন্দ্র মোদী না জানুন, তাঁর আর্থিক পরামর্শদাতারা নিশ্চয় এই কথাটা জানতেন। তবুও, মোদী ঘোষণা করলেন ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’— ভারতে উৎপাদনের ওপর জোর দেওয়ার প্রকল্প।

Advertisement

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৮ ০০:৪২
Share:

দূর গ্রাম থেকে বাস ভাড়া করে যাঁরা শহরে আসেন নেতার বক্তৃতা শুনতে, অথবা এক বেলার রিকশা চালানো বন্ধ করে, দোকানদারি শিকেয় তুলে যাঁদের আসতে হয় সেই সভায়, সেই ভারতবর্ষকে একটা প্রশ্ন কেউ কখনও করেনি। ‘‘আচ্ছা বলুন তো, চিনা মালে আমাদের বাজারগুলো ভরে যাচ্ছে কেন? মোবাইল থেকে টুনি বাল্‌ব, পাপোশ থেকে এলইডি টেলিভিশন, সবই কেন মেড ইন চায়না?’’ প্রশ্নটা কখনও করা হয়নি, সেটা অকারণে নয়। কারণ, এই প্রশ্নের উত্তর এই ভারতবর্ষের কাছে নেই। কিন্তু, এঁদের অনেকের মোবাইলেই হোয়াটস্যাপ-ফেসবুকের মেসেজে আছে চিনা পণ্য বয়কট করে ভারতীয় জিনিস কেনার জাতীয়তাবাদী আহ্বান। দীপাবলিতে চিনা আলো না কিনে প্রদীপ জ্বালানোর বার্তা তাঁরা পেয়েছেন ও পাঠিয়েছেন। চিন শত্রু, তাঁরা জানেন। নেতারাই জানিয়েছেন। কিন্তু শত আহ্বানেও কেন চিনকে আটকানো যায় না, সে কথা তাঁদের কেউ বলেননি।

Advertisement

২০১৪ সালে এই ভারতকেই উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। যে ভারত রাজনীতির চাপানউতোর বোঝে, কংগ্রেস আর বিজেপির আকচাআকচি বোঝে, এমনকী বিদেশনীতিতে জাতীয়তাবাদী হুঙ্কারও উপভোগ করে, কিন্তু অর্থনীতি বোঝে না। আর, সেই ভারতকেই চার বছর ধরে লালনপালন করে গিয়েছেন তিনি। চিনা পণ্যের কথাই বলি না-হয়। উৎপাদন-ক্ষেত্রটাকে চিন ঠিক কোন জায়গায় নিয়ে গিয়েছে, সেটা বুঝতে দুটো উদাহরণই যথেষ্ট। প্রথমটা মেড ইন চায়না ‘টিবেট উইল বি ফ্রি’ লেখা টি-শার্ট! দ্বিতীয়টা, ‘অ্যামেরিকা ফার্স্ট’ লেখা টুপি-পতাকাও তৈরি হয়ে এসেছিল চিন থেকে। গোটা দুনিয়ার সব বাজারেই চিনের কার্যত একাধিপত্য। আর, আর্থিক সংস্কারের পর থেকে ভারত কখনও উৎপাদনের দিকে তেমন জোরই দেয়নি। কাজেই, চিনের সঙ্গে উৎপাদনের লড়াই করতে চাওয়ার ইচ্ছেটা অবাস্তব।

নরেন্দ্র মোদী না জানুন, তাঁর আর্থিক পরামর্শদাতারা নিশ্চয় এই কথাটা জানতেন। তবুও, মোদী ঘোষণা করলেন ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’— ভারতে উৎপাদনের ওপর জোর দেওয়ার প্রকল্প। ভারতে শিল্প-উৎপাদন বাড়লে তাঁর চরম বিরোধীও আপত্তি করবেন না। মুশকিল হল, মোদী প্রকল্পটাকে মুড়ে ফেললেন ভারত বনাম চিনের আজব দ্বৈরথে, তাতে চড়ালেন উগ্র জাতীয়তাবাদের রং। বললেন না, চিনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা অনর্থক, বরং আমরা চেষ্টা করি উৎপাদনে এত বছরের পিছিয়ে থাকা অবস্থান থেকে একটু একটু করে সামনের দিকে এগোতে। এটা বললে আর রাজনীতি থাকে না, হাততালি থাকে না। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ ধরাশায়ী হয়েছে— তার অনেকগুলো কারণের মধ্যে অর্থনীতির ঘাড়ে রাজনীতিকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও একটা।

Advertisement

বলতেই পারেন, কথায় কী এসে যায়? কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনা এই প্রশ্নের একটা উত্তর দেবে। ২০১৪ সালে যখন দিল্লির মসনদে বসেছিলেন মোদী, তখন একশো দিনের কাজ প্রকল্প নিয়ে কম মশকরা করেননি। বলেছিলেন, প্রকল্পটাকে তিনি রেখে দেবেন কংগ্রেসের ব্যর্থতার, ভ্রান্ত নীতির প্রতীক হিসেবে। এনআরইজিএ তাঁর কাছে ছিল নিতান্তই কংগ্রেস জমানার বাজে জিনিস। গ্রামীণ জীবনের ওপর এই প্রকল্প কী প্রভাব ফেলছে, গ্রামের প্রান্তিক মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ায় ভারত আর্থিক মহামন্দার ধাক্কা কতখানি সামলাতে পারল, অর্থনীতির এই প্রশ্নগুলো তাঁকে ভাবায়নি মোটেও— রাজনীতির রঙেই তাঁর চোখ আটকে ছিল। প্রকল্পটা উঠে যায়নি, কিন্তু অবহেলার ছাপ তার সর্বাঙ্গে। বহু কাজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি জানা গেল, প্রকল্পের অর্ধেক মজুরির টাকাই আটকে রয়েছে সরকারের ঘরে। তাতে কয়েক কোটি ঘরে উনুনের আঁচ নিভে গেল কি না, সে কথা যদি না-ও ভাবেন, গ্রামে চাহিদা কমলে জিডিপি-র কতখানি ক্ষতি হবে, প্রধানমন্ত্রী সেটুকু ভাবতে পারতেন। তিনি ভাবেননি। এনআরইজিএ-র কঙ্কালটুকু রাখার কথা ছিল তাঁর। তিনি সেটুকুই রেখেছেন।

ভয় থাকত, যদি মানুষের প্রশ্নের মুখে পড়তে হত। কিন্তু অর্থনীতির অলিগলিতে ঘুরে প্রশ্ন করার চেয়ে যে পছন্দের নেতার ওপর বিশ্বাস রাখা অনেকখানি সহজ— এমনকী নেতা অপছন্দের হলেও অর্থনীতির চেয়ে রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন করা মানুষের পক্ষে সহজ— এই কথাটি নরেন্দ্র মোদী বিলক্ষণ জানেন। একশো দিনের কাজের টাকা আসতে দেরি হলে তার কারণ খুঁজতে খুঁজতে প্রধানমন্ত্রীর দোরগোড়ায় পৌঁছনো কঠিন। বিশেষত সেই দেশের পক্ষে, যে বিশ্বাস করে নিয়েছিল, নোট-বাতিলের দৌলতে রুজিরুটি বন্ধ হয়ে যাওয়াটাও আসলে সিয়াচেন সীমান্তে লড়তে থাকা জওয়ানদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য জরুরি। যে দেশ প্রশ্ন করেনি, নিতান্ত অপ্রস্তুত অবস্থায় জিএসটি চালু করে দিতে হল কেন? যে দেশ জানতে চায়নি, বিশ্ববাজারে পেট্রলের দাম যখন তলানিতে, তখনও ভারতে দাম তেমন কমল না কেন? সেই দেশ জানতে চায় না, বিশ্ববাজারে তেলের দাম যখন ঊর্ধ্বমুখী, তখন কোন জাদুমন্ত্রে অমিত শাহ তা কমিয়ে দেবেন।

মানুষ প্রশ্ন করবে না জেনেই তাই ঘোষণা করে দেওয়া যায়, কৃষকের আয় পাঁচ বছরে দ্বিগুণ করা হবে। তার জন্য কৃষিতে বছরে কত শতাংশ হারে আয়বৃদ্ধি প্রয়োজন, সেই হিসেব মানুষ কষবে না, প্রধানমন্ত্রী জানেন। কষলে দেখা যেত, পাঁচ বছরে আয় দ্বিগুণ করার জন্য বছরে প্রায় ১৫ শতাংশ হারে আয়বৃদ্ধি প্রয়োজন। ভারতীয় কৃষিতে? যেখানে আয়বৃদ্ধি চার শতাংশের গণ্ডি ছাড়াতে পারে না? পাঁচ বছরে দ্বিগুণ আয়ের প্রতিশ্রুতি যে ডাহা মিথ্যে, নরেন্দ্র মোদী বিলক্ষণ জানেন। যেমন মিথ্যে ছিল ডলারের দামকে চল্লিশ টাকায় নামিয়ে আনা, কালো টাকা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি। তিনি জানেন, মানুষ এই মিথ্যের দিকে আঙুল তুলবে না, বরং বিশ্বাস করে যাবে নেতাকে।

প্রশ্নহীন আনুগত্য ভারতীয় রাজনীতির ধরন। অতএব, সম্পূর্ণ অ-প্রশিক্ষিত মানুষের ভরসায় কী ভাবে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ হবে, কী ভাবেই বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর মতো নতুন এবং সর্বব্যাপী প্রযুক্তির বাজারে ভারত জায়গা করে নেবে, চার বছরে মানুষ জানতে চায়নি। শিক্ষাক্ষেত্রকে যে ভাবে সম্পূর্ণ অবহেলা করে এই সরকারের বাজেট, তাতে কি কখনও ভারতের পক্ষে কী উৎপাদন শিল্পে, কী নতুন যুগের তথ্যপ্রযুক্তিতে বিশ্বশক্তি হওয়া সম্ভব? নরেন্দ্র মোদী জানেন, মানুষ এই সব প্রশ্ন করবে না। ফলে, তিনি উত্তরও দেন না। সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি সম্পূর্ণ মিথ্যে দাবি করতে পারেন যে ইউপিএ-র আমলে ব্যাঙ্কের অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ঢের বেশি ছিল। কারণ, তিনি জানেন, মানুষ পরিসংখ্যান ঘাঁটবে না। কেউ সেই তথ্য সামনে এগিয়ে দিলেও মানুষ ফিরে তাকিয়ে দেখবে না যে ইউপিএ আমলে যে অনাদায়ী ঋণ ছিল মোট ব্যাঙ্কঋণের ৩.৮ শতাংশ, মোদীর চার বছরে তা বেড়ে দশ শতাংশের গণ্ডি ছাড়িয়ে গিয়েছে। মানুষ প্রশ্ন করবে না, স্কিল ইন্ডিয়া, স্টার্ট আপ ইন্ডিয়া-র মতো প্রকল্প গোড়াতেই মুখ থুবড়ে পড়ল কেন? জানতে চাইবে না, বছরে এক কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতি ঠিক কেন রক্ষা করতে পারলেন না প্রধানমন্ত্রী?

চার বছরে নরেন্দ্র মোদী জেনেছেন, অর্থনীতি নিয়ে মানুষ প্রশ্ন করে না। এমনকী, ভাতের থালায় হাত প়়ড়লেও নয়। এই জানাই ভারতীয় অর্থনীতিকে আজকের জায়গায় দাঁড় করিয়েছে, যেখানে বহুপ্রতিশ্রুত ৮ শতাংশ বৃদ্ধির হার নাগালের বহু বাইরে, আর আর্থিক অসাম্যও ক্রমবর্ধমান। তা হলে, দোষটা কার? নেতার, না কি অর্থনীতি নিয়ে প্রশ্ন করতে না জানা মানুষের?

সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কঠিন। তবে, অন্য এক প্রধানমন্ত্রীর কথা বলি। তিনি সদ্য-স্বাধীন ভারতে এক জনসভা থেকে অন্য জনসভায় মানুষকে অর্থনীতির যুক্তি বুঝিয়ে বেড়াতেন। পঞ্চবার্ষিকী যোজনা কেন দেশের জন্য জরুরি, বলতেন সেই কথা। এবং, অনেক অপ্রিয় কথাও বলতে হত তাঁকে। মানুষকে কতখানি ত্যাগস্বীকার করতে হবে, এখনই কী কী চাওয়া যাবে না, তার তালিকা দিতেন। আর বলতেন, অর্থনীতি নিয়ে প্রশ্ন করো আমায়। যে প্রশ্ন মনে আসে, সেটাই। মানুষকে অর্থনীতির যুক্তিতে বেঁধে নিতে না পারলে দেশ এগোবে না, বিশ্বাস করতেন সেই প্রধানমন্ত্রী।

যদি বলেন, মাত্র চার বছরে এতখানি হয় না, তবে মনে করিয়ে দিই, নেহরুর প্রধানমন্ত্রিত্বের তখনও চার বছর হয়নি। দেশের স্বাধীনতারও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন