সম্পাদকীয় ১

জরুরি আপত্তি

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে আপত্তিগুলি করিয়াছেন, তাহার যাথার্থ্য প্রশ্নাতীত। যদি কেন্দ্রীয় সরকারই একতরফা ভাবে সমস্ত সিদ্ধান্ত করিতে থাকে, তবে ‘যুক্তরাষ্ট্রীয়তা’ কথাটি নেহাত হাসির খোরাক হইয়া যায়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০৩
Share:

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে আপত্তিগুলি করিয়াছেন, তাহার যাথার্থ্য প্রশ্নাতীত। যদি কেন্দ্রীয় সরকারই একতরফা ভাবে সমস্ত সিদ্ধান্ত করিতে থাকে, তবে ‘যুক্তরাষ্ট্রীয়তা’ কথাটি নেহাত হাসির খোরাক হইয়া যায়। যোজনা কমিশনের নাম মুছিয়া নীতি আয়োগ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। পূর্বসূরি প্রতিষ্ঠানটির সর্বাঙ্গে কেন্দ্রীয় আধিপত্যের ছাপ ছিল। নেহরুর আমল হইতেই যোজনা কমিশন ছিল কেন্দ্রের হাতিয়ার, যাহার মাধ্যমে রাজ্যগুলির উপর বহুতর সিদ্ধান্ত চাপাইয়া দেওয়া হইত। নীতি আয়োগকে যদি পৃথক হইতেই হয়, তবে এই বিন্দুটিই তাহার ‘পয়েন্ট অব ডিপারচার’ হইতে পারিত। বস্তুত, কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে সমন্বয়সাধনই এই প্রতিষ্ঠানটির প্রধানতম কর্তব্য। কিন্তু, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে আপত্তিটি করিয়াছেন, তাহাতেই স্পষ্ট— গো়ড়ায় গলদ রহিয়া গিয়াছে। প্রতিষ্ঠানের নাম বদলাইয়াছে, কিন্তু শাসকদের ডিএনএ হইতে কেন্দ্রীয় কর্তালির অভ্যাসটি যায় নাই। ফলে, নীতি আয়োগের কোন কমিটিতে কে থাকিবেন, কোন কাজটি কোন পথে হইবে— সেই সমস্ত সিদ্ধান্তই মুখ্যমন্ত্রীদের অজান্তেই হইয়া যাইতেছে। ক্ষমতার উচ্চাবচতা লইয়া কোনও সংশয় নাই— কেন্দ্র উপরে, রাজ্যগুলি নীচে। বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলি সহজবোধ্য কারণেই চুপ। নীতীশ কুমার-নবীন পট্টনায়কদের নীরবতারও রাজনৈতিক তাৎপর্য বোঝা সম্ভব। কিন্তু, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একা প্রতিবাদ করিয়াছেন বলিয়াই তাহার গুরুত্ব কম, এই কথা ভাবিলে মস্ত ভুল হইবে। দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয়তার স্বার্থেই তাঁহার প্রতিবাদ গুরুত্বপূর্ণ।

Advertisement

তবুও, প্রশ্ন থাকিয়া যায়। নীতি আয়োগের পরিসরটি ছাড়িয়া দেওয়ার নহে। তিনি কেন আয়োগের বৈঠকে হাজির ছিলেন না, এই প্রশ্নের উত্তরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহার আপত্তিগুলির কথা বলিলে তাহা খানিক অজুহাতের মতোই শোনায়। মনে হয়, তিনি রাজনৈতিক বিরোধকে নীতিগত আপত্তির মোড়কে পেশ করিতে চাহিতেছেন। বৈঠকে গরহাজির থাকা এই কারণেই তাঁহার কৌশলগত ভুল। তিনি আয়োগের পরিসরেই নীতির আপত্তিগুলি উত্থাপন করিতে পারিতেন। অন্যান্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদেরও বুঝাইতে পারিতেন, কেন সংকীর্ণ রাজনীতি-নির্বিশেষে কেন্দ্রের এই আধিপত্য মানিয়া লওয়া রাজ্যের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক। এই লড়াই যে তাঁহার একার নহে, এই কথাটি স্পষ্ট করিয়া বলিবার জন্যও আয়োগের বৈঠকের পরিসরটি জরুরি ছিল। রাজনীতি একটি শিল্প, সেই শিল্পের কৌশলগুলি আয়ত্ত করা জয়লাভের আবশ্যিক শর্ত। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এই কথাটি বিস্মৃত হইলে তাঁহার রাজনীতিরই ক্ষতি।

নীতিগত ভাবেও বৈঠকে উপস্থিত থাকাই তাঁহার উচিত ছিল। আলোচনা গণতন্ত্রের প্রধানতম শর্ত। যেখানে মতের মিল আছে, সেখানে আলোচনা সহজ। যেখানে অমিল, সেখানে আলোচনার মাধ্যমে মধ্যপন্থা খুঁজিয়া লওয়াই গণতন্ত্রের মাহাত্ম্য। মতাদর্শগত ভাবে তীব্রতম বিরোধীপক্ষের সহিতও, অতএব, আলোচনায় বসিতে হয়। নীতি আয়োগ সেই আলোচনার প্রাতিষ্ঠানিক পরিসর ছিল। লক্ষণীয়, নরেন্দ্র মোদী কিন্তু দরজাটি বন্ধ করেন নাই। তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরবর্তী বৈঠকগুলিতে উপস্থিত থাকিতে অনুরোধ করিয়াছেন। এই অনুরোধ যে কৌশলগত, তাহাতে সংশয় নাই। কিন্তু, গণতন্ত্রের স্বার্থে এই আপাত-সৌজন্যও জরুরি। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কে যাহাতে ভারসাম্য আসে, ক্ষমতার উচ্চাবচতা যাহাতে খণ্ডিত হয়, তাহা নিশ্চিত করিতে হইলে নীতি আয়োগের পরিসরেই সেই ল়ড়াই লড়িতে হইবে। ভিন্নতর একটি ল়়ড়াই অবশ্য সম্ভব— জরুরিও— নীতি আয়োগ নামক প্রতিষ্ঠানটি আদৌ থাকিবে কেন, মুখ্যমন্ত্রী সেই প্রশ্ন করিতে পারেন। কিন্তু, যত ক্ষণ না তিনি সেই লড়াইয়ে নামিতেছেন, তত ক্ষণ প্রতিষ্ঠানটিকে এড়াইয়া যাওয়া অনুচিত।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন