উলটা বুঝিলি রাম। খাদ্য অপচয় রুখিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রামবিলাস পাসোয়ানের হাঁকডাক দেখিয়া এমনই আক্ষেপ হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সম্প্রতি মনে করাইয়াছেন, খাদ্য অপচয় রোধ করিলে বহু অভুক্ত মানুষের অন্ন জুটিত। বক্তব্যে ভুল নাই। ভারতে উৎপাদিত নানাবিধ খাদ্যের চল্লিশ শতাংশ নষ্ট হয়, যাহার মূল্য তিরাশি হাজার কোটি টাকা। সবজি-ফলের অপচয় সর্বাধিক (সত্তর শতাংশ)। ভারত নানাবিধ শস্য ও দুগ্ধে বিশ্বের অন্যতম প্রধান উৎপাদক, কিন্তু প্রধান অপচয়কারীও বটে। কিন্তু ভুল হইতেছে খাদ্য ও গণবণ্টন মন্ত্রীর নীতি নির্বাচনে। অপচয় রোধে তিনি রেস্তোরাঁর মালিকদের উদ্দেশে হুঙ্কার ছাড়িলেন। ইহাই কি খাদ্য বাঁচাইবার সর্বাধিক কার্যকর উপায়? খেত-খামার হইতে বাজার অবধি আসিতে অন্তত সিকিভাগ কৃষিপণ্য নষ্ট হয়, আরও কিছু নষ্ট হয় বাজারে। উপযুক্ত সংরক্ষণ ও পরিবহণের অভাব তাহার প্রধান কারণ। আলু ব্যতীত প্রায় কোনও সবজির হিমঘর নাই, হিমায়িত গাড়ি নাই। ফলে খাদ্যগুণপূর্ণ কৃষিপণ্য পচিয়া নষ্ট হয়। সরকারি গুদামে চাল-গম খাইয়া যায় ইঁদুর। অপর সমস্যা কৃষিবিপণন। ভারতে চাষি ও কৃষি ব্যবসায়ী সংগঠিত নহে, বৃহত্তর বাজার ধরিতে তাহারা শেখে নাই। স্থানীয় চাহিদা মিটিলেই সবজি-ফল উদ্বৃত্ত হয়। রাস্তায় টম্যাটো, আলু, করলা ফেলিয়া চাষিরা প্রতিবাদ করেন। একটি সমীক্ষা অনুসারে, অপচয় না হইলে শস্য ও সবজির দাম অন্তত অর্ধেক হইত। তাহাতে ক্ষুধা-অপুষ্টিও মিটিত। চাহিদার চাইতে অধিক উৎপাদন সত্ত্বেও এ দেশ অপুষ্টিতে বিশ্বের প্রায় শীর্ষস্থানে। খাদ্য অপচয়ই তাহার কারণ।
যথাযথ বিপণন, সংরক্ষণ এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের প্রয়োজন লইয়া কম কথা হয় নাই। অথচ উপযুক্ত পরিকাঠামো ও প্রযুক্তি নিশ্চিত করা হয় নাই। এই জরুরি কাজটি ভুলিয়া এখন রেস্তোরাঁয় খাদ্য অপচয় রুখিবার মতো লঘু একটি কাজ নির্বাচন করা হইল। পাসোয়ান বলিয়াছেন, তিনি রেস্তোরাঁর খাবার অপচয় হইতে দেখিয়াছেন, তাই তাহা রোধ করিতে চাহেন। মন্ত্রিমহাশয়ের অভিজ্ঞতা মূল্যবান, কিন্তু কোনও ব্যক্তির ধারণার ভিত্তিতে সরকারি নীতি নির্ধারিত হইতে পারে না। তথ্য ও পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে নীতি স্থির হয়। মন্ত্রী-আমলাদের অবিবেচনার জন্য সরকারের অপচয়ের হিসাব কেউ করে নাই। ভ্রান্ত বিচার হইতে ভ্রান্ত নীতি, তাহার জন্য ব্যর্থ প্রকল্প, ইহা এ দেশে প্রায় নিয়ম হইয়া উঠিয়াছে। কখনও মশা মারিতে কামান, কখনও হাতি মারিতে গুলতি ছুটিয়াছে। কত সম্পদ জলে গিয়াছে, কত জীবন ব্যর্থ হইয়াছে, তাহার পরিমাপ আজ সম্ভব নহে।
নেতাদের আশা, হুঙ্কার দিয়া তোলপাড় ফেলিয়া দিলে প্রমাণ হইবে যে তাঁহাদের মনে সদিচ্ছার বারুদ ঠাসা। তাই কোনও এক উপলক্ষ জুটিলেই জাঁকজমক লাগাইয়া দেন। তাঁহারা ভুলিয়াছেন, সরকারের সাধ্য সীমিত। যেখানে সরকারের উদ্যোগ সর্বাধিক খাদ্য সংরক্ষণ নিশ্চিত করিবে, সেই ক্ষেত্রটি নির্বাচন করিয়া সর্বশক্তি প্রয়োগ করিতে হইবে সরকারকে। অকারণে সরকারের সময় ও বিত্তের ক্ষয় দেশের অপচয় বইকী। ক্ষুধার সূচকে শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশের চাইতেও পিছাইয়া ভারত। একশো আঠারোটি দেশের মধ্যে তাহার স্থান সাতানব্বই। রেস্তোরাঁর খাবার বাঁচাইয়া সে স্থান বদলাইবে না। অপচয় দুঃখজনক, নির্বুদ্ধিতা ভয়ানক।