প্রতীকী ছবি।
প্রজাতন্ত্র দিবসে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে নিহত এক ও আহত কতিপয়: উনসত্তর বৎসরে এমন ঘটনা বেশি শোনা যায় নাই। নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বে দেশ আবারও একটি কৃতিত্বের অধিকারী হইল। বিজেপি কুলতিলক মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশে বরেলী-সন্নিহিত কাসগঞ্জে ২৬ তারিখ কয়েক ডজন হুমকিবাজ হিন্দুত্ববাদী তেরঙা পতাকাবাহী মোটরসাইকেল-আরোহীর আস্ফালন হইতে এই সংঘর্ষের সূত্রপাত। তবে সংঘর্ষই ঘটনার মূল কথা নহে। জেলার ম্যাজিস্ট্রেট নিয়মানুযায়ী সংঘর্ষ ও তাহার ‘সূত্র’ ধরিয়া আইনের শাসন ফিরাইতে চাহিলে তাঁহাকে বাধা দেওয়া হয়, স্লোগানদাতা আক্রমণকারীদের হাত হইতে মুসলিমদের রক্ষা করিবার প্রয়োজনীয়তা তিনি মনে করাইয়া দিলে উপমুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ তোলেন যে ম্যাজিস্ট্রেট মহাশয় বিশেষ একটি ‘রাজনৈতিক দল’-এর মুখপাত্রের মতো কথা বলিতেছেন। ফেসবুকে ম্যাজিস্ট্রেট এই ঘটনা বিষয়ে তাঁহার ব্যক্তিগত মত ‘পোস্ট’ করিলে তাঁহাকে সেই পোস্ট প্রত্যাহার করিতে হয়। সব মিলাইয়া বুঝাইয়া দেওয়া হয়, প্রশাসন কোনও মতেই দলীয় রাজনীতির বাহিরে পা দিতে পারিবে না। অতঃপর যদিও রাজ্যপাল রাম নায়েক দুঃখপ্রকাশ করেন, তাঁহার বার্তা হইতে প্রশাসনিক নিরপেক্ষতার কোনও প্রতিশ্রুতি নিষ্কাশন করা মুশকিল। সুতরাং, বলা যায়, আদিত্যনাথের প্রশাসন প্রত্যাশিত পথেই অগ্রসর হইতেছে, মুসলমান মহল্লায় ঢুকিয়া তীব্র পাকিস্তান-হিংসার হুমকি দিবার কাজটি নিশ্চয় হিন্দু ভারত প্রতিষ্ঠাযজ্ঞেরই একটি প্রধান কর্মসূচি। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পর্যন্ত যেখানে মুসলমানদের অধিবাসীদের সাধারণ নাগরিক সুরক্ষা দিবার অধিকারী নহেন, সেখানে সামাজিক পরিস্থিতি কতটা হিংসাদীর্ণ, তাহা কেবল এক পলকের হিসাব।
লক্ষণীয়, এমন ঘটনাও সম্প্রতি কালে কত কম আলোচিত হয়। প্রজাতন্ত্রে রাষ্ট্রের সকল নাগরিক রাষ্ট্রের সহিত একটি ঘনিষ্ঠ সংযোগ অনুভব করিবে: ভারতীয় সংবিধানের গোড়ার এই কথা মনে করিলে এখন দুর্ভাগ্যজ্বালায় মাথা হেঁট হইয়া আসে। এখন এ-দেশে প্রজাতন্ত্র দিবস সংখ্যাগুরু সমাজের যুব-প্রতিনিধিদের গুন্ডাগিরির উৎসব, যাহাতে সংখ্যালঘু কিংবা প্রান্তিক মানুষের প্রতি বার্তা অতি প্রত্যক্ষ: কোনও মতেই যেন তাহারা প্রান্তিকতার গণ্ডির বাহিরে পা না বাড়ায়। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর, অথচ রাজ্য সরকারের তরফে সুবিচার বা ন্যায়প্রতিষ্ঠার কোনও আশ্বাস নাই। প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় সরকারের নীরবতা তো এ-সব বিষয়ে স্বর্ণালি হইতে প্ল্যাটিনাম পর্যায়ে পৌঁছাইতে চলিয়াছে!
এই নীরবতা ন্যক্কারজনক, কেননা ইহার মধ্যে নীচতার পরিমাণটি সহজবোধ্য। কাসগঞ্জের ঘটনা ঘটিবার কয়েক ঘণ্টা আগে প্রজাতন্ত্র দিবসের সকালেই রাষ্ট্রপতি কোবিন্দের মুখে শোনা গিয়াছে দেশের বৈচিত্র রক্ষা করিবার প্রয়োজনীয়তা, মুসলিম নারীদের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা। কিন্তু মুসলিমদের প্রতি দায় কি কেবল তালাক প্রথার ক্ষেত্রেই, সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে শূন্য? এক দিকে মুসলিম দেখিলেই পাকিস্তানে চলিয়া যাইতে বলিবার ব্যস্ততা, অন্য দিকে রাষ্ট্রপতির বক্তৃতাতে সম্প্রীতির কিছু বাক্য গুঁজিয়া দেওয়া: উঁচু দরের ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছু নয়। তাই প্রধানমন্ত্রী তাঁহার নীরবতায় যতই বাঙ্ময় হন, রাষ্ট্রপতির বার্তা ততই দ্রুত অর্থহীনতায় পর্যবসিত হইয়া যায়।