শুভবুদ্ধি, জ্ঞান, তর্ক

আজকের পৃথিবী তথা ভারত সম্বন্ধে এমনটাই বলছিলেন অধ্যাপক অমর্ত্য সেন, সুমন ঘোষের তৈরি তথ্যচিত্রে, বা তার পরে দীর্ঘ আলোচনাপর্বে। নিজের জীবনের কথা বলতে বলতে বার বার নিয়ে আসছিলেন ধর্ম আর রাজনীতির পাঠ।

Advertisement

সুমিত চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০১৭ ১৩:৩০
Share:

কথা: কৌশিক বসু ও অমর্ত্য সেন। শান্তিনিকেতন, ডিসেম্বর ২০১৬। সুমন ঘোষের তথ্যচিত্র ‘দি আরগুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান’ তোলার সময়

এক বিপন্ন সময়ের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে তর্জনীর স্পষ্ট নির্দেশে মননঋদ্ধ পণ্ডিত বুঝিয়ে দেন, ‘এই সত্য’। সংকটের মুহূর্তে পৃথিবীর যে কোনও অবস্থানে এই প্রাজ্ঞ মানুষেরা নিশ্চিত পৌঁছে যান, আশ্চর্য সমাপতনের মতো। প্যালেস্তাইনের নির্বাসিত কবি মুরিদ বারগুতি যেমন স্মৃতিচারণ করছেন কয়েক বছর আগের ঘটনার। তিনি চলেছেন রামাল্লা শহর থেকে বিরযাইত বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে। সঙ্গে রয়েছেন ওলে সোয়িঙ্কা, মাহমুদ দারভিশ, বেই দাও, হুয়ান গোয়তিসোলো, হোসে সারামাগো এবং আরও অনেকে। বন্ধুর পথ, হেঁটে অতিক্রম করতে হবে সুরদা চেকপোস্ট। এক দিকে নিরবচ্ছিন্ন রুক্ষ পর্বতমালা, তার ভিতর সেঁধিয়ে থাকা ছোট ছোট গ্রাম, মাঝে ডাইনামাইটের সাহায্যে তৈরি কৃত্রিম পরিখা, চার পাশে উদ্ধত ইজরায়েলি বন্দুকের নল। দাঁড়িয়ে পড়লেন সারামাগো। আপন মনেই বলে উঠলেন: এখানকার মানুষ একটা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বাস করছে। এটা সত্যিই কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। আমি সেটাই মনে করি।

Advertisement

আজকের পৃথিবী তথা ভারত সম্বন্ধে এমনটাই বলছিলেন অধ্যাপক অমর্ত্য সেন, সুমন ঘোষের তৈরি তথ্যচিত্রে, বা তার পরে দীর্ঘ আলোচনাপর্বে। নিজের জীবনের কথা বলতে বলতে বার বার নিয়ে আসছিলেন ধর্ম আর রাজনীতির পাঠ। রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য আর শান্তিনিকেতনে দশ-এগারো বছর বয়সে গাঁধীজির সঙ্গে সাক্ষাতের অমলিন স্মৃতি। বলছিলেন তর্কপ্রিয় ভারতবাসীর সূক্ষ্ম বিচারের ঐতিহ্যের ইতিহাস। বিভিন্ন ধারার দর্শন বা ধর্মাচরণে সলতে পাকানো ভারতবাসীর দীর্ঘকাল যাবৎ সযত্নে লালিত জটিল আর বহুধাবিস্তৃত সাংস্কৃতিক অভ্যাসের কথা। যে অভিঘাতচর্চিত অভ্যাস সহজেই ‘এথিকস’ আর ‘মরালিটি’ শব্দ দুটোর মধ্যেকার ফারাক বুঝে নিতে জানে।

আসলে মনে হল, সমাগত শিক্ষিতজনের প্রতি স্থির নির্দেশ দিচ্ছেন তিনি। যে সব শিক্ষা ভুলতে বসেছি, যে সব আকরগ্রন্থ বিস্মৃত হয়েছি সম্পূর্ণ, তাই ফিরে পড়বার নির্দেশ। ধর্ম আর সমাজের পাঠ আরও এক বার নতুন করে অনুশীলন করে নিতে বলছেন প্রবীণ দার্শনিক। মনে করিয়ে দিলেন চতুর্দশ শতাব্দীতে মাধবাচার্যের লেখা ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ সন্দর্ভটি কেন অবশ্যপাঠ্য। এই গ্রন্থে মাধবাচার্য ষোলোটি ‘হিন্দু’ দর্শনের কাঠামো প্রায় তর্কের আকারে প্রস্তাবনা করেছেন। শুরুতেই রয়েছে নিরীশ্বরবাদী চার্বাক-লোকায়ত, ক্রমে বৌদ্ধ দর্শন, জৈন দর্শন, পাণিনীয় দর্শন, আর সবশেষে বেদান্ত দর্শন। স্বাভাবিকভাবেই অনেক ক্ষেত্রে এই দর্শন প্রণেতাদের অবস্থান পরস্পরবিরোধী, কিছু ক্ষেত্রে প্রায় বিপরীতধর্মী। যাপনের দর্শন নিয়ে নানা মুনির নানা মত। ভিন্নতা আর তর্কের অবকাশ আসলে ভারতবর্ষের ধর্মচেতনার মূলে প্রোথিত, এই কথাই বার বার মনে করিয়ে দিতে চাইলেন অমর্ত্য। আধুনিক, স্বাধীন ভারতের রাজনীতির ইতিহাস যে অনেক সময়েই একটা ‘হিন্দু ভারতের সীমিত ধারণা’, সে কথা স্পষ্ট করে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। স্মরণে রাখা প্রয়োজন, ধর্মকেন্দ্রিক এই সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি স্বাধীন ভারতের আধুনিকতার কড়চার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িত।

Advertisement

ধর্ম নিয়ে এই চর্চার পিঠোপিঠি এল রাজনীতি আর গণতন্ত্রের প্রসঙ্গ। তথ্যচিত্রেও এল, এল মুখোমুখি আলোচনাতেও। এই প্রসঙ্গে অমর্ত্য মনে করিয়ে দিলেন জন স্টুয়ার্ট মিল-এর বাণী: গণতন্ত্র আদতে ‘গভর্নমেন্ট বাই ডিসকাশন’। আলোচনার পথ খোলা রাখাই গণতন্ত্রের মূল আদর্শ। এই প্রসঙ্গে আক্ষেপ করলেন যে, আধুনিক ভারতে কোনও মূলধারার দক্ষিণপন্থী ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল তৈরি হল না। তা হলে আরও এক রকমের আলোচনার পরিসর তৈরি হয়ে উঠত। ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতি-প্রসূত হিংসাকে তফাতে রেখে অন্য আর এক রকম পুঁজিনির্ভর দক্ষিণপন্থার চর্চা সম্ভব ছিল। এতে মতের বিস্তর অমিল হত নিঃসন্দেহে, তিনি নিজে যে সেই মতের বিরোধী, সেটাও জানালেন স্পষ্ট ভাষায়, কিন্তু নতুন কিছু শিখে নেওয়ার আয়োজনও হত নিশ্চিত। অমর্ত্যর বয়ানে যার নাম ‘সহমত না হয়ে শেখা’। গণতান্ত্রিক কাঠামোর প্রাণিত বিন্যাসে এ-ও এক জরুরি পাঠ।

ক্রমাগত বলীয়ান রাজনৈতিক হিংসা, ধর্মীয় উসকানি, বিশ্বব্যাপী অসহিষ্ণুতা—দৃশ্যতই চিন্তিত তিনি। যে তিনটি উপমহাদেশে নিজের জীবনের এক-তৃতীয়াংশ করে কাটিয়েছেন অমর্ত্য— বিশ্বের সেই তিন প্রান্তই আজ নানা কারণে ধ্বস্ত। আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের অসহিষ্ণু আস্ফালন, ব্রিটেন তথা ইউরোপে ব্রেক্সিট-পরবর্তী বিভাজন এবং তৎপরবর্তী অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত, আর এশীয় উপমহাদেশ তথা ভারতে ক্রমবর্ধমান হিংসার রাজনীতি। প্রতি মুহূর্তে তাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন, ‘আইডেন্টিটি’ শব্দটার সঙ্গে ‘ভায়োলেন্স’ শব্দটার কোনও সহজাত, স্বাভাবিক সম্পর্ক নেই। সহিষ্ণুতার আলোচনা করতে গিয়ে তাই বার বার চলে আসছিল গৌতম বুদ্ধের কথা, সংবেদী তর্কের ভিতর দিয়ে ধার্মিক বা রাজনৈতিক উপলব্ধিতে পৌঁছনোর কথা।

রাজনীতির কারবারিরা এই তর্কলব্ধ, গণতান্ত্রিক, সহিষ্ণু পথের দিশারি হবেন না কোনও দিন। এর দায় নিতে হবে সাধারণ, শিক্ষিত জনগণকে। সোশ্যাল মিডিয়ার আগ্রাসী আবেদনের ভিতরেও ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করছে লাগামহীন হিংসা আর প্রতিহিংসা-সঞ্জাত মিথ্যার বেসাতি। মুহূর্তের ভিতর কোটি কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে হিংসার এই ভয়ংকর বিশ্বজনীন প্রকল্প। একে প্রতিহত করবার দায় আমাদেরই— দেশের শিক্ষিত মানুষের। আর তাই, ভারতের, মায় বিশ্বের, সামাজিক ও দার্শনিক ইতিহাস আর এক বার ফিরে পড়বার নির্দেশ দিচ্ছেন অমর্ত্য। নৈতিকতার (মরালিটি) পাঠকে জ্ঞানবিশ্বের (এপিস্টেম) পাশাপাশি রেখে বার বার ঝালিয়ে নিতে হবে, রাজনীতিকের চটজলদি টোটকার মোহজালে আবিষ্ট হয়ে পড়লে চলবে না। এই প্রকল্পে প্রয়োজন নিবিষ্ট জ্ঞান অন্বেষণের শ্রম, বুঝে নেওয়া আর বুঝিয়ে বলার মনোযোগী, যত্নশীল চর্চা। আর অবশ্যই সেই চর্চার পরিবেশ আর পরিসর জনমানসে রচনা করা। অ্যান্ড্রু মারভেল-এর ‘টু হিজ কয় মিসট্রেস’ কবিতার প্রসঙ্গ টেনে আবার তিনি মনে করিয়ে দেন, ‘ওয়ার্ল্ড এনাফ অ্যান্ড টাইম’— যথেষ্ট পরিসর এবং সময়— আমাদের কাছে নেই। অতএব, এখনই এই কাজে প্রবৃত্ত হওয়ার আশু প্রয়োজন।

ধর্ম আর ঈশ্বর সংক্রান্ত একটা কৌতুকময় অথচ ইঙ্গিতবহ ঘটনার কথা চারণ করে সে দিনের সন্ধ্যায় ইতি টানলেন অমর্ত্য। বলছিলেন তাঁর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির কথা। নোবেল বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর নৈশভোজ। সেখানেও পুরস্কার প্রাপকের একটা স্বল্প সময়ের বক্তৃতা দেওয়াই রীতি। সেই ছোট বক্তৃতায় তিনি উদ্ধৃত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য...’ বললেন, ওই একই প্রেক্ষিতে আর এক ভারতীয় নোবেলজয়ী সুব্রহ্মণ্য চন্দ্রশেখরও রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটিই বেছে নিয়েছিলেন। শুধু, এর ইংরাজি তর্জমায় শেষ পঙ্‌ক্তিতে নাস্তিক চন্দ্রশেখর ‘হেভেন অব ফ্রিডম’ শব্দবন্ধটিকে বদলে বলেছিলেন ‘হাভেন (haven) অব ফ্রিডম’। (নিরীশ্বরবাদী অমর্ত্য অবশ্য সেই ‘সংশোধন’ করেননি!)

তলিয়ে ভাবলে বোঝা খুব কঠিন নয় যে এও গল্পের ছলে এক রকম নির্দেশ। ঈশ্বর আর ধর্মের প্রাসঙ্গিকতার বা প্রয়োজনীয়তার বেড়া ডিঙিয়ে মুক্ত জ্ঞানের সাধনার আয়োজন। ধর্মসঞ্জাত পৌত্তলিকতা আর সেখান থেকে নিক্ষিপ্ত বিদ্বেষকে প্রতিহত করে জাগরূক এক আধুনিকতা। মনে হল যেন বোঝাতে চাইলেন যে ধর্মীয় মৌলবাদের বিষ আসলে ওই স্বর্গ বা জন্নত প্রাপ্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষার ভিতরেই সুপ্ত রয়েছে। পৌত্তলিক বিশ্বাসের মিনারে ক্ষণিকের আঘাত লাগলেই, আপাত-অচঞ্চল ঈশ্বরবাদের ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়ে সাম্প্রদায়িকতা আর মৌলবাদের নিরিখ, আর তার সরলীকৃত ব্যবহার করে মন্দজনে।

শুভবুদ্ধি, তর্ক, আর পরস্পর জ্ঞান বিনিময়ের শ্রম, এই সহিষ্ণু জীবনবোধ আঁকড়ে ধরতে অক্ষম হলে বুঝি আর গতি নেই।

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন