রক্তাল্পতা নিয়ে একটু আলাদা করে ভাবনার দরকার আছে। পশ্চিমবঙ্গের সাড়ে চার কোটিরও বেশি মানুষের রক্তে লোহিতকণিকার ঘাটতি। ২০১৫-১৬ সালের ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের হিসেব অনুযায়ী এই রাজ্যে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি নারীদের ৬২.৮ শতাংশ রক্তাল্পতায় ভুগছেন। এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিহারে ৬০, অসমে ৪৬, ওড়িশায় ৫১, রাজস্থানে ৪৬ ও উত্তরপ্রদেশে ৫২ শতাংশ মহিলা রক্তাল্পতায় ভুগছেন। আরও ভয়ের ব্যাপার— দশ বছর আগে এ রাজ্যে এই হারটা ছিল ৬৩.২, কুড়ি বছর আগে ৬২.৭। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে অ্যানিমিয়া অনড় হয়ে রয়েছে বহু দিন। ২০১৬’র একটি রিপোর্ট অনুযায়ী নবজাতকদের মধ্যে কম ওজনের শিশুর অনুপাত এ রাজ্যে ৩১ শতাংশ। তার একটা কারণ মায়ের রক্তাল্পতা। পাঁচের থেকে কম বয়সি শিশুদের মৃত্যুর হার হাজারে ৩২ হওয়ার পিছনে মূল কারণ অ্যানিমিয়া। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ভারত সরকার, হেসপেরিয়ান-এর মতো সংস্থা বলছে, অ্যানিমিয়া হলে মানুষের শেখার ক্ষমতাটাই কমে যায়। সাধারণ লেখাপড়া শেখাই কঠিন হয়, জটিল বিষয় তো দূরস্থান। অ্যানিমিয়া মেয়েদের (৩০ ভাগ ছেলেদেরও) দু’দিক থেকেই মেরেছে। তার হাত-পায়ের পেশিকে মেরেছে, বুদ্ধিকেও।
ভরসার কথা, এই সমস্যা থেকে মুক্তির পথ আছে। ডব্লিউএইচও এবং ভারত সরকার খুব ভাল গাইডলাইন প্রকাশ করেছে। ভারত সরকার ন্যাশনাল আয়রন ইনিশিয়েটিভ নিয়েছিল ২০১৩ সালে। পশ্চিমবঙ্গেরও একটা উদ্যোগ আছে। তবে দুটোই চাহিদার তুলনায় খুব ছোট আয়োজন। অ্যানিমিয়া নানা রকমের ও নানা কারণে হয়। থ্যালাসিমিয়া, টিবি, ম্যালেরিয়া, কৃমি, ভিটামিনের ঘাটতি বা পেটের রোগেও রক্তে লোহিতকণিকা কমে যায়। তবে শতকরা আশি জনেরই হয় আয়রন ও ভিটামিন ঘাটতির অ্যানিমিয়া (আয়রন ডেফিশিয়েন্সি অ্যানিমিয়া), যথাযথ উদ্যোগ করলে যা কমানো যায়। তমলুকের কাছে একটি সংস্থার উদ্যোগে গরিবপাড়ায় শিশু ও মায়েদের নিয়ে এ রকম একটা কাজ হয়েছে গত এক বছর ধরে। তাদের রিপোর্টে কিছু ভাবনার কথাও প্রকাশিত হয়েছে। একশোটি পরিবারের সঙ্গে কাজে নেমে এক বছরে সেখানে অ্যানিমিয়ার হার নামানো গেছে ১০ শতাংশের নীচে। কর্মীরা নিজেরা নিয়মিত ভাবে কৃমির ওষুধ, আয়রন ট্যাবলেট ও ভিটামিন খাইয়েছেন। কলকাতা থেকে ডাক্তারদের একটি দল চার বার শিবির করে সবাইকে পরীক্ষা করেছেন। ডায়টিশিয়ানরা খাবারের নিয়মকানুন দফায় দফায় মেয়েদের শিখিয়ে গিয়েছেন। পানীয় জল শোধন ও শৌচ নিয়ে নিয়মিত ছোট ছোট আলাপ ও সভা হয়েছে। পাঁচ দফায় রক্ত পরীক্ষা করে লোহিতকণিকার গণনা হয়েছে।
এ ঘটনা দেখাল, পারা যায়। কয়েকটি জরুরি কথাও বোঝা গিয়েছে: ওষুধ ও খাবার দরকার, তবে তার থেকেও বেশি দরকার খাদ্যবিধি জানা ও মানা, জলদূষণ দূর করা ও সাফসুতরো থাকা। কেন এ সব নিয়ম মানব, সেগুলোও বোঝা ও মানা দরকার, বিশেষ করে ঘরের পুরুষদের। আর এই কাজে ডাক্তার চাই। কারণ, দশ থেকে পনেরো শতাংশ মানুষের রক্তের ঝামেলা একটু জটিল। আয়রন ইনিশিয়েটিভ-এ শিশু ও বালিকাদের কিছু স্কুলে আয়রন ট্যাবলেট ও কৃমির ওষুধ খাওয়ানো শুরু হয়েছে। এই রিপোর্ট বলছে সেখানেও চার মাসে এক বার ডাক্তার দেখানো দরকার। ডায়াটিশিয়ানদের আলোচনা মেয়েদের বার বার শোনা দরকার। যে বিষয়টা ভাল করে বোঝা দরকার তা হল, অ্যানিমিয়া নিশ্চয়ই কমানো যায়, তবে সেই কমানোটা বজায় রাখা কঠিন। স্কুলের সঙ্গে গ্রামের পাড়াগুলি ধরে কাজ করলে উন্নতি হবে এবং সচেতনতাও বাড়বে। শিক্ষক ও আশাকর্মীদের পাশে তাই গ্রামের লোকজনকেও সহায়তা করতে হবে। সংস্থাটি এ রকম কর্মী গড়ে নিয়েছেন বলেই সরকারের উপর ভর না দিয়েও অনেকটা পেরেছেন।
তবে, ওষুধ খাইয়ে লোহিতকণিকা বাড়িয়ে নেওয়াটা কতটা যুক্তিযুক্ত? আর তাই অ্যানিমিয়া দূর করতে খাবারের ওপর নজর দেওয়া দরকার। সেই জন্যই এখানে অনেক ঘরে লেবু ও নানা ফলের চারা লাগানো হয়েছে। পরিবারের খাবারের প্রয়োজন মেটাতে মায়েরা ছাতু উৎপাদনের আয়োজন করছেন। খাবারের বিধি সম্পর্কে নিয়মিত সচেতনতা প্রসারের কাজ চলেছে। সরল ভাষায় এ বিষয়ে বই লিখে পড়ানো হয়েছে। খাওয়ার ওপর জোর দিয়ে রক্তাল্পতা দূর করার ধারণাটাই বোধ করি বহু দিন ধরে এ দেশে অনেকের বলা পথ। তবুও প্রয়োজনে ওষুধ খেয়ে যেতে হবে। আর এই অসুখ দূর করার ক্ষেত্রে বৃহত্তর সমাজের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। বহু দরিদ্র মানুষ সাহায্যের অভাবে রোগের শিকার থেকেই যাচ্ছেন। সরকার ও সমাজ যদি এই রোগ সারানোর উদ্যোগ নেয় তবে একটা ভয়ানক ইতিহাসের ইতি হতে পারে।