শেষ অঙ্কে শূন্য

হাটেবাজারে সর্বত্র এই ধীরে চলা ধীরে বলা মানুষগুলি সম্পর্কে, অর্থাৎ আক্ষরিক অর্থে তাল মিলাইয়া না চলিতে পারা প্রাণীগুলি সম্পর্কে, সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রকট মনোভাব: এই প্রান্তিক মানুষগুলি মূল স্রোতে না ভিড়িবার চেষ্টা করিলেই সকলের মঙ্গল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৭ ০০:৫৪
Share:

সমীক্ষায় প্রকাশ, ভারতের জনসাধারণ বয়স্কদের প্রতি উদাসীন, এমনকী নির্মম আচরণ করিয়া চলিয়াছেন। সমীক্ষায় প্রায় অর্ধেক বয়স্ক মানুষ বলিয়াছেন, প্রকাশ্য পথেঘাটে তাঁহাদের সহিত দুর্ব্যবহার করা হয়, অর্ধেকের অধিক বলিয়াছেন ভারতীয় সমাজ বয়স্কদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে। আরও অধিক সংখ্যক বয়স্ক বিশ্বাস করেন, বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাদের সহিত দুর্ব্যবহার করিলে তাহার প্রতিবাদ কেহ করে না। অথচ, ভারতীয় সংস্কৃতি বলিতে সাধারণ মানুষ যাহা বুঝে, তাহার অন্যতম বৈশিষ্ট্য: বয়স্কদের সম্মান প্রদান। তাঁহারা আসিয়া পড়িলে দ্রুত সিগারেট লুকাইতে হয়, তাঁহারা অযৌক্তিক বকুনি দিলেও হাস্যমুখে মানিয়া লইতে হয়। কিন্তু বাস্তবে, ঘরে তো বটেই, বাহিরেও, নিত্যযাত্রায়, যানবাহনে, বৃদ্ধদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ ভূরি ভূরি। মেট্রোয় যে সিটগুলি বয়স্কদের জন্য সংরক্ষিত বলিয়া লিখা রহিয়াছে, সেইগুলি ছাড়িয়া দিতেও অ-বৃদ্ধদের প্রবল অনীহা ও বিরক্তি, তাহা অনেকে প্রকাশ্যে দেখাইতেও দ্বিধা বোধ করে না। অথচ একটি প্রকৃত সভ্য সমাজে, স্বতন্ত্র ভাবে লিখিয়া দিবারও প্রয়োজন নাই, বৃদ্ধ মানুষ উঠিলে সিট ছাড়িয়া দেওয়াই দস্তুর। অটোয় উঠিবার কালে বৃদ্ধার অধিক সময় লাগিতেছে, তিনি চটপট লাফাইয়া বসিয়া পড়িতে পারিতেছেন না বলিয়া, চালক বাঁকা মন্তব্য করিবে, এমনকী জোরে চালাইয়া দিবে, যাহাতে বৃদ্ধা হাঁচড়পাঁচড় করিয়া উঠিতে বাধ্য হন অথবা পড়িয়া যান, এই ঘটনাও বিরল নহে। হাটেবাজারে সর্বত্র এই ধীরে চলা ধীরে বলা মানুষগুলি সম্পর্কে, অর্থাৎ আক্ষরিক অর্থে তাল মিলাইয়া না চলিতে পারা প্রাণীগুলি সম্পর্কে, সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রকট মনোভাব: এই প্রান্তিক মানুষগুলি মূল স্রোতে না ভিড়িবার চেষ্টা করিলেই সকলের মঙ্গল।

Advertisement

যুধিষ্ঠির হইলে নিশ্চয় বলিতেন, বিশ্বের সকলেই এক কালে জরাগ্রস্ত হইবে, অথচ কেহই সে কথা বিশ্বাস করিতেছে না, ইহাই সর্বাধিক বিস্ময়ের। এই শেষ অঙ্কে নিজেকে পৌঁছাইতেই হইবে জানিয়াও সেই দশায় উপনীত মানুষের প্রতি এমন উপেক্ষা জন্মায় কোথা হইতে? তবে এই ব্যবহারে কেবল নিজের পরিণতি সম্পর্কে অসচেতনতাই নাই, আছে প্রবল অন্যায়: দুর্বলকে আঘাত করিবার পাপ। যাঁহারা বয়স্ক, তাঁহারা জীবনাভিজ্ঞতার কারণে নিশ্চিত ভাবে কমবয়স্কদের তুলনায় অধিক জ্ঞানী, ও সুতরাং শ্রদ্ধেয়, এ কথা মানিয়া লইতে কেহ বলিতেছে না। কিন্তু শিশু, বৃদ্ধ বা রোগীর প্রতি সর্বদাই অধিক যত্ন ও শুশ্রূষা লইয়া অগ্রসর হইতে হইবে, কারণ তাঁহারা এই মুহূর্তে গতি বা দ্রুতির সমীকরণে, শারীরিক কারণেই, অংশ লইতে অপারগ। তাঁহাদের অক্ষমতাকে দেখিতে হইবে সমমর্মিতা লইয়া, করুণা লইয়া নহে, তিক্ততা লইয়া তো নহেই। সভ্যতার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ: অন্যের প্রতি মনোযোগ ও সহানুভূতিপূর্ণ বিবেচনার অভ্যাস। বুঝিতে হইবে, বৃদ্ধবৃদ্ধারা বয়সের সুবিধা লইয়া অন্যায় অগ্রাধিকার বাগাইয়া লইতেছেন না। তাঁহাদের বয়সজনিত অসুবিধার কথা ভাবিয়া যদি সহায়তার হাত না বাড়াইয়া দেওয়া হয়, তাহাই হইবে জীবনের প্রতি তীব্র অসমীচীনতা।

আসলে, কেবল বয়স্কদের ক্ষেত্রেই নহে, ভারতে জনজীবনে অভদ্রতা ইতরতা প্রায় নিয়ম হইয়া দাঁড়াইয়াছে। তাহার জন্য হয়তো বিস্ফোরক জনসংখ্যা, প্রকাণ্ড যানজট, অর্থনৈতিক অব্যবস্থা, এবং এই সকলের যোগফলে ব্যক্তির প্রবল শারীরিক কষ্ট ও মানসিক শ্রান্তি দায়ী, কিন্তু সহ-মনুষ্যের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ কোনও যুক্তিতেই সমর্থন করা যায় না। পথে কাহাকেও ধাক্কা মারিয়া চলিয়া গেলাম, দৃকপাতও করিলাম না, বাসের দরজা জুড়িয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম, নড়িলাম না, গাড়ির চালক হইয়া বিনা কারণে বারংবার কর্ণবিদারী হর্ন বাজাইলাম, পথচারী হইয়া সিগনালের তোয়াক্কা না করিয়া রাস্তা পার হইলাম, ভিড়ে কেহ সরিয়া দাঁড়াইতে বলিলেই তেরিয়া হইয়া অপমানজনক মন্তব্য করিলাম, এগুলি প্রাথমিক আদবকায়দার বিরোধী। কেহ এই রূঢ়তাকে সপ্রতিভতার সহিতও গুলাইয়া ফেলিতেছেন। এই অশিষ্টতা, এবং ইহার মূলে যে অশ্লীল ভাবনা: ‘পৃথিবী কেবল সুস্থ সবল সতেজদের জন্য, বাকিরা হটিয়া যাও’, তাহা অধিক অনুচিত হিসাবে প্রতিভাত হয় যখন উহা প্রতিবন্ধী বা বয়স্ক মানুষের প্রতি প্রযুক্ত হয়, তাঁহাদের স্পষ্ট বোধগম্য শ্লথতাকে অক্ষমার চক্ষে দেখা হয়। বুনিয়াদি সহনশীলতা ও সমঝদারি যদি জীবন হইতে উবিয়া যায়, তবে কেবল ফেসবুকে দেশপ্রেমের ভেঁপু বাজাইয়া ভারতের ‘মহান’ হওয়া দুষ্কর।

Advertisement

যৎকিঞ্চিৎ

পারলে তাজমহলের গায়েও ছুরি দিয়ে খোদাই করে অমুক প্লাস তমুক লিখে আসতে হয়, এ বাহাদুরির কথা সবার জানা। কিন্তু অনেকে ভাবে, এ সৃষ্টিশীল অভ্যাস শুধুই ভারতীয়দের। সম্প্রতি আইসল্যান্ডের বিখ্যাত শ্যাওলা-ঢাকা পাহাড়ে মুঠো মুঠো শ্যাওলা ছিঁড়ে নিয়ে কারা লেখা তৈরি করল, ‘সেন্ড ন্যুডস’! এই শ্যাওলা ফের গজাতে বহু দশক লেগে যাবে। অর্থাৎ গোটা পৃথিবীতেই ট্যুরিস্টরা বাঘা বেয়াদব, এবং তাদের কানে কে বলে চলেছে, ‘বেড়াতে এসেছিস যখন, একটা দাগ রেখে যা’!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন