Editorial News

বোনা হচ্ছে আর একটা জাল, জড়িয়ে পড়লে চলবে না

কট্টর হিন্দুত্ববাদী কার্যকলাপের অভিযোগ সামনে এলে আঙুলটা সর্বাগ্রে বিজেপি বা সঙ্ঘ পরিবারের দিকেই ওঠে। দিল্লির ঘটনাতেও আঙুলটা সে দিকেই উঠেছে। কিন্তু উগ্র হিন্দুত্ববাদে উস্কানি দিতে বা ধর্মীয় মেরুকরণ ঘটাতে ইস্যুর অভাব তো নেই।

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৮ ০০:১০
Share:

প্রতীকী ছবি।

একটা অশুভ সঙ্কেত মিলল। সঙ্কেতটা অনেক দিন ধরে তীব্র হচ্ছে বা ক্রমান্বয়ে একই রকম উপসর্গ উঠে আসছে, বিষয়টা তেমন নয় এখনও। লক্ষণটা নতুনই। সদ্য উঁকি দিয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত বিপজ্জনক বার্তা বয়ে এনেছে সে।

Advertisement

খুব নিঃশব্দে যেন প্ররোচিত করা হল দিল্লির বাতাসকে। ষড়যন্ত্রের একটা জাল যেন বোনা হয়েছে কোনও গোপন, অন্ধকার ডেরায়।

রাজধানীর সফদর জঙ্গ এনক্লেভে ‘ঐতিহ্যবাহী কাঠামো’ হিসেবে বিবেচিত তুঘলক আমলের এক ঐতিহাসিক সৌধ আচমকা একটা মন্দির হয়ে উঠেছে। রাতারাতি রঙের পোঁচ পড়েছে, সৌধের ভিতরে বেশ কিছু মূর্তিও জুটে গিয়েছে।

Advertisement

প্রায় একই সময়ে সেন্ট স্টিফেন’স কলেজেও সাম্প্রদায়িক উস্কানির চেষ্টা প্রকট হয়েছে। কলেজের খ্রিস্টান উপাসনাগৃহের সদর দরজায় কারা লিখে দিয়েছে যে, সেখানে মন্দির বানানো হবে।

দিল্লি বেশ চমকে গিয়েছে। ঐতিহ্যবাহী সৌধের মন্দির হয়ে ওঠার খবর প্রকাশ্যে আসতেই বিতর্ক এবং চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। সেই বিতর্ক এবং চাঞ্চল্যের আগুনে অক্সিজেন জুগিয়েছে স্টেন্ট স্টিফেন’স কলেজের চ্যাপেলের দরজায় হিন্দুত্ববাদীর স্লোগান লিখে দেওয়ার খবর। ঘটনা দুটোর খবর প্রায় একই সঙ্গে যে ভাবে সামনে এসেছে, তাতে দুটোর একটাকেও বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। অনেকেই একে দিল্লির বুকে দেখা দেওয়া এক নব্য কট্টরবাদী প্রবণতা মনে করছেন।

কট্টর হিন্দুত্ববাদী কার্যকলাপের অভিযোগ সামনে এলে আঙুলটা সর্বাগ্রে বিজেপি বা সঙ্ঘ পরিবারের দিকেই ওঠে। দিল্লির ঘটনাতেও আঙুলটা সে দিকেই উঠেছে। কিন্তু উগ্র হিন্দুত্ববাদে উস্কানি দিতে বা ধর্মীয় মেরুকরণ ঘটাতে ইস্যুর অভাব তো নেই। বিজেপি বা সঙ্ঘ পরিবারের হাতে রামমন্দির ইস্যু তো এখনও রয়েছে, সে সমস্যার সমাধান এখনও হয়নি। তা হলে নতুন ইস্যু খোঁজার চেষ্টা কেন? এমন প্রশ্ন তুলছেন অনেকে।

উত্তরটা পাওয়া কিন্তু খুব কঠিন নয়। দেখতে দেখতে রামমন্দিরের বয়স হল অনেক, অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরির ইস্যুটারও বয়স কম হল না। আগুন কমে এসেছে সম্ভবত সেই ইস্যুতে, সমাজে খুব দ্রুত আড়াআড়ি মেরুকরণ সম্ভবত আর ঘটাতে পারছে না রামমন্দির আন্দোলনের স্লোগানগুলো। তাই এ বার নতুন ইস্যুর খোঁজ, মেরুকরণের নতুন হাতিয়ার খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা। আশির দশক, নব্বইয়ের দশক— দীর্ঘ সময় ধরে রামমন্দির আন্দোলন কাঁপিয়ে দিয়েছে ভারতীয় রাজনীতিকে। আর সেই আন্দোলনে ভর করে তরতর করে অগ্রগতি হয়েছে গেরুয়া শিবিরের। কিন্তু কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত বিস্তৃত বিপুলায়তন দেশে এক সময় ঘরে ঘরে যে রকম উন্মাদনা ছড়িয়েছিল অযোধ্যায় মন্দির বানানোর ‘তাগিদ’, পাড়ায় পাড়ায় যে ভাবে শিলাপূজন শুরু হয়েছিল, দেশের নানা প্রান্ত থেকে যে ভাবে ইট নিয়ে অযোধ্যায় যাওয়ার হিড়িক পড়েছিল, যে ভাবে তরুণ প্রজন্মের একটা অংশকেও কট্টরবাদী আন্দোলনে সামিল করা গিয়েছিল, উন্মাদনায় ভর করে যে ভাবে বাবরি মসজিদ ধসিয়ে দেওয়া গিয়েছিল, সে এখন অতীত। রামমন্দির বা রামমন্দির আন্দোলনের নামে সম্ভবত আর খেপিয়ে তোলা যাচ্ছে না আজকের তরুণ প্রজন্মকে। তাই নতুন কোনও ইস্যু চাই, নতুন কোনও কট্টরবাদী কার্যকলাপ চাই, নতুন কোনও মেরুকরণমুখী বিতর্ক চাই, যা বর্তমান প্রজন্মের চোখের সামনে তৈরি হল। সে কথা মাথায় রেখেই সম্ভবত রাজধানীর বুকে প্রায় একই সঙ্গে দুটো বিতর্কিত ঘটনা ঘটে গেল, যা সাম্প্রদায়িক উস্কানির পক্ষে যথেষ্ট।

ষড়যন্ত্র কে করল, কোন ডেরা থেকে হল, সে নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু দিল্লির বুকে দুটি সাম্প্রদায়িক প্ররোচনামূলক ঘটনা যে ভাবে প্রায় একই সঙ্গে ঘটল, তার নেপথ্যে ষড়যন্ত্র রয়েছে, সে নিয়ে সংশয় খুব একটা নেই। অতএব বিপদটা টের পাওয়া যাচ্ছে। অতএব আরও বেশি সতর্ক থাকার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে। চক্রান্তের জাল কোথাও হয়তো বোনা হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। কিন্তু বুঝতে যখন পারছি আমরা, তখন কিছুতেই জালে জড়াব না, কিছুতেই ফাঁদে পা দেব না। এই অঙ্গীকার যদি নিজেদের কাছে নিজেরা করতে পারি, অচিরেই ছিঁড়ে যাবে সদ্য বোনা সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্রের জালটা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন