Editorial News

অন্যায়ের প্রতিবাদ অন্যায় দিয়ে হয় না

অন্যায়ের প্রতিকার কখনও অন্যায়ের মাধ্যমে হয়নি, পৃথিবীর ইতিহাস তার সাক্ষী। বিলোনিয়ায় লেনিন মূর্তি ভাঙার প্রতিবাদ যাঁরা করলেন কলকাতায় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মূর্তি নষ্ট করার মাধ্যমে, তাঁরা ইতিহাসটা জানেন না।

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৮ ০০:৩৫
Share:

কলকাতা, ত্রিপুরা এবং চেন্নাইয়ে ভাঙা হয়েছে মূর্তি।

লড়াই যখন অন্যায় বা অসত্যের বিরুদ্ধে, তখন হাতিয়ারটা অন্যায় বা অসত্য হতে পারে না। যা অশিব বা অসুন্দর, তার প্রতিবাদ সেই অশিবের মাধ্যমেই হতে পারে না। অন্যায়ের প্রতিকার কখনও অন্যায়ের মাধ্যমে হয়নি, পৃথিবীর ইতিহাস তার সাক্ষী। বিলোনিয়ায় লেনিন মূর্তি ভাঙার প্রতিবাদ যাঁরা করলেন কলকাতায় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মূর্তি নষ্ট করার মাধ্যমে, তাঁরা ইতিহাসটা জানেন না।

Advertisement

ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে ভারতে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন মহাত্মা গাঁধী। আন্দোলন অহিংস রাখা যায়নি। ১৯২২ সালে চৌরিচৌরা বীভত্স হত্যালীলার সাক্ষী হয়েছিল। বিন্দুমাত্র আপোস করেননি গাঁধী। আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করেছিলেন তত্ক্ষণাত্।

যে সময়ে গাঁধীজি আন্দোলনে ইতি টানার কথা ঘোষণা করেছিলেন, অহিংস অসহযোগ আন্দোলন তখন তীব্রতায় এবং প্রাবল্যে তুঙ্গস্পর্শী। গোটা ভারত স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল মহাত্মা গাঁধীর সিদ্ধান্তে। চৌরিচৌরার ভুলে গোটা ভারত কেন শাস্তি পাবে? সমগ্র দেশ যখন ব্রিটিশরাজ বিরোধী আন্দোলনে অভিভূত, দেশের অধিকাংশ এলাকাতেই যখন আন্দোলন অহিংসই, তখন চৌরিচৌরার হিংসাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেও তো দেখা যেতে পারে! একটা হিংসাত্মক কাণ্ডের জন্য সুবৃহত্ অহিংস আন্দোলনটা কেন স্তব্ধ করে দেওয়া হবে? এমনই অনেক প্রশ্নের অবতারণা সে দিন হয়েছিল গাঁধীজির সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে। কিন্তু মহাত্মা গাঁধী সিদ্ধান্ত বদলাননি।

Advertisement

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

সত্যের সাধনা বা সত্যের সন্ধানই পথ যাঁর, বিন্দুমাত্র অসত্যের সঙ্গেও সহাবস্থান করতে পারেন না তিনি। সত্য অবশ্যই নিখাদ, তাতে কণামাত্র ভেজালও থাকতে পারে না। চৌরিচৌরার ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন আখ্যা দিয়ে আন্দোলন জারি রাখলে আসলে সত্যের পথ থেকে বিচ্যুতি ঘটত অথবা সে এক জোড়াতালি বা গোঁজামিলের সত্য হয়ে উঠত। মহাত্মা গাঁধীর সাধনা তার জন্য ছিল না। তাঁর সাধনা নিখাদ সত্য তথা শিব তথা সুন্দরের। অতএব থেমে গিয়েছিল অহিংস অসহযোগ আন্দোলন।

আরও পড়ুন: মূর্তি-দায় ঠেলছেন মোদীরা

গাঁধীজির কাছ থেকে এইটুকু শিক্ষাও কি আমরা নিতে পারি না? ত্রিপুরায় লেনিনের মূর্তি ভাঙার ঘটনা দ্ব্যর্থহীন ভাবে নিন্দনীয়। দেশের প্রত্যেক প্রান্ত থেকে সমালোচিত হচ্ছে এই ঘটনা। যে বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে লেনিনের মূর্তি ভাঙার অভিযোগ উঠেছে, সেই বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বও এমনকী সমর্থন করতে পারেননি এই কুকীর্তিকে। তা হলে কোন বুদ্ধিতে বা কোন যুক্তিতে বাংলায় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মূর্তি ভেঙে ত্রিপুরার ঘটনার প্রতিবাদ করা যায়? অপরাধের প্রতিবাদে আরও একটা অপরাধ? এই সাধারণ প্রশ্নটা কেওড়াতলার হামলাকারীদের মাথায় এল না?

আরও পড়ুন: নৈরাজ্যের কোনও ‘যুক্তি’ হয় না

আরও পড়ুন: লজ্জা লাগছে! অশিক্ষিত লোকজনে রাজনৈতিক দলগুলো ভরে যাচ্ছে

গণতন্ত্রে তো বটেই, সভ্য সমাজেও বর্বরতার কোনও ঠাঁই নেই। আর মূর্তি ভাঙার উল্লাস বর্বরতা ছাড়া অন্য কিছুই নয়। সভ্যতার ইতিহাস সাক্ষী, অগণতান্ত্রিকতা কখনও স্থায়িত্ব লাভ করতে পারে না। মূর্তি যাঁরা ভাঙছেন, তাঁরা আসলে ইতিহাসটা জানেন না।

ইতিহাসের চাকা পিছন দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা যাঁরা করেন, তাঁরা কখনওই সফল হতে পারেন না। ইতিহাস হল মানবসভ্যতার অগ্রগমনের কাহিনি। আবার ইতিহাস পিছনে ফেলে আসা পরিসরটার আখ্যানও। যা কিছু আমাদের এগিয়ে আনল এত দূর, আচমকা পিছন ফিরে বেছে বেছে তার নির্দিষ্ট কোনও অংশকে ধ্বংস করতে আমরা পারি না। হঠাত্ একটা মূর্তি ভেঙে দিয়ে আমরা আমাদের অতীত বদলে ফেলতেও পারি না।

আরও পড়ুন: মূর্তি ভাঙচুর দক্ষিণেও, ছাড় বিজেপি নেতাকে

অর্থাত্ মূর্তি ভাঙার রাজনীতি আমাদের অতীতটাকে বদলে দিতে পারবে না। মূর্তি ভেঙে বা বর্বরতা দেখিয়ে কোনও সত্যেও পৌঁছনো যাবে না। এই উপলব্ধি যাঁদের নেই, তাঁদের রাজনীতি বৃথা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন