জয়ী হল বাংলার যৌথ সাধনার ঐতিহ্য

প্রমাণ হল, এটা পশ্চিমবঙ্গ

বাংলায় হিন্দ-মুসলমান সংঘাত অতীতে হয়নি, এমন তো নয়। ১৯৪৭ সালের আগে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের স্মৃতিও বাঙালির একান্ত নিজস্ব। তবে বাংলায় দাঙ্গার ইতিহাস যেমন সজীব, তেমন এ কথাও সত্য যে, ব্রিটিশ যুগ থেকে আজ পর্যন্ত বাঙালি বার বার এই সাম্প্রদায়িক হানাহানিকে অতিক্রম করে সম্প্রীতির আবহকেই প্রতিষ্ঠা করেছে।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৭ ০৬:১০
Share:

সমন্বয়: মহরমের আগে দরগায় মোমবাতি দিচ্ছেন হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষ। কৃষ্ণনগর। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

পুজোর সময়টা সততই আনন্দের। কিন্তু এ বার দিল্লিতে উৎসব-যাপনের মধ্যেও খুব টেনশনে ছিলাম পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে। বিজয়া দশমী আর মহরম— গায়ে গায়ে দুই অনুষ্ঠান নিয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির এমন চেষ্টা আগে কখনওই দেখিনি। বিজয়া দশমীর ঠিক এক পক্ষকাল আগে থাকতেই দিল্লিতে বিজেপির কেন্দ্রীয় কার্যালায়ে বসে দলের মুখপাত্ররা বলতে শুরু করলেন, পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুসলিম তোষণের জন্য বাংলার হিন্দুসমাজ সুসংহত হচ্ছে। তাঁদের বাসনা, বাংলায় হিন্দু নবজাগরণ চাই।

Advertisement

এর পর আদালত, টিভি বিতর্ক— অনেক কাণ্ড। আমি ভোট-বাক্সের জন্য সংখ্যালঘু তোষণের সমর্থক কখনওই নই। মুসলিম তোষণ মুসলিম উন্নয়ন নয়। কিন্তু যে রাজ্যে প্রায় শতকরা ত্রিশ ভাগ মুসলমান, সে রাজ্যে মেরুকরণের রাজনীতির কৌশল কোন হিন্দু সমাজের কল্যাণের জন্য? দাঙ্গা বাধিয়ে হিন্দু উদারতাকে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক এঁদোগলির দিকে ঠেলে দেওয়া কি কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ মেনে নিতে পারেন?

আজ আপনাদের সকলকে তাই শুভ বিজয়া জানাচ্ছি গর্বের সঙ্গে। এ ভাবে বলছি, কারণ এ রাজ্যে সমস্ত প্ররোচনাকে উপেক্ষা করে বাঙালি দেখিয়ে দিয়েছে, নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ বাংলায় ভোটের জন্য যতই অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করুন না কেন, বাঙালি এই ভেদবুদ্ধির সহজ শিকার হতে রাজি নয়।

Advertisement

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী, আপনি ২০১৪ সালে ভোটে জিতেছেন। আবার জিততে চান ২০১৯ সালে। আপনার সুযোগ্য সেনাপতি অমিত শাহ বাংলা দখল করতে চান সাম্প্রদায়িকতার তাস ব্যবহার করে। বিজেপির রাজনৈতিক বৃদ্ধির জাতীয়তাবাদী তাসটি মুসলমান বিরোধিতার মধ্যেই নিহিত। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, তিনি উন্নয়নের জন্য দায়বদ্ধ, ভোটের রাজনীতি করেননি। দোহাই, এমন অসত্য না-ই বা বললেন। বাংলায় মেরুকরণের রাজনীতিকে ভোটের রাজনীতি না বললে, কত্তা, ঘোড়ায় হাসবে কিন্তু। দেখুন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুসলিম তোষণ করছেন বলে যতই প্রচার চালান না কেন, এ বার রাজ্যের মুসলমানরা রাজ্যের অধিকাংশ স্থানে মহরম শান্তিপূর্ণ ভাবেই পালন করেছেন। এমনকী দেখলাম জলপাইগুড়িতে মহরমের মেলা ও লাঠি খেলায় স্থানীয় হিন্দুরা অংশ নিয়েছেন। বিজয়া দশমীর ভাসানের উৎসবও রাজ্যে মহাসমারোহে পালিত হয়েছে। উল্টে বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশে কানপুর থেকে গাজিয়াবাদে একই সময়ে একই কারণে হানাহানির খবর এসেছে।

বাংলায় হিন্দ-মুসলমান সংঘাত অতীতে হয়নি, এমন তো নয়। ১৯৪৭ সালের আগে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের স্মৃতিও বাঙালির একান্ত নিজস্ব। তবে বাংলায় দাঙ্গার ইতিহাস যেমন সজীব, তেমন এ কথাও সত্য যে, ব্রিটিশ যুগ থেকে আজ পর্যন্ত বাঙালি বার বার এই সাম্প্রদায়িক হানাহানিকে অতিক্রম করে সম্প্রীতির আবহকেই প্রতিষ্ঠা করেছে। আজ এত বছর পর সেই রেনেসাঁস-ভূমিতে, রামমোহন রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দের দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ রোপণ করতে গিয়ে আবার ব্যর্থ হলেন মোদী-অমিত শাহ।

শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বাংলায় বিজেপি এগোতে পারল না, এ দুঃখ ছিল বাজপেয়ী-আডবাণীরও। মনে পড়ে, বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রীকে খুব পছন্দ করতেন দু’জনেই। তবু তাঁকে সরিয়ে যখন তপন শিকদারকে দলের রাজ্য সভাপতি করা হল, তখন আডবাণী আমাকে বলেছিলেন, শাস্ত্রীজি সংস্কৃতে পণ্ডিত। একনিষ্ঠ সৎ মানুষ। কিন্তু কী করা যাবে? শাস্ত্রী পদবি নিয়ে তো কেউ বাংলার বিজেপি নেতা হতে পারেন না। বাংলাকে বাংলার মতো করেই ভাবতে হবে। বাজপেয়ী এক বার দলের কর্মসমিতির বৈঠকে যোগ দিতে দিল্লি থেকে কলকাতা যাচ্ছিলেন। সঙ্গে ছিলাম। উনি বলেছিলেন, হিন্দি বলয়ে সংঘের রাজনীতি যা-ই হোক, পশ্চিমবাংলায় একই ভাবে এগোলে ভুল হবে। বাঙালির মননের মধু যে জয় শ্রীরাম ধ্বনিতে নেই, সেটা রামমন্দির আন্দোলনের সময়েও আডবাণী বুঝেছিলেন। গোটা দেশে যে ঝড় উঠেছিল, সেই ধর্মীয় উন্মাদনার প্রভাব বাংলায় কার্যত ছিল না।

একটা গল্প বলি। পথের পাঁচালী যখন মেট্রোতে রিলিজ করে, বাজপেয়ী-আডবাণী দু’জনে নাইট শো-তে সেই ছবি দেখেছিলেন। তখন ট্যুইটার ছিল না। কিন্তু পর দিন দু’জনেই সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এই ছবিতে বাঙালির মননের পরিচয় পাওয়া যায়। গোবিন্দাচার্যকে কলকাতায় দায়িত্ব দিয়ে পাঠানোর সময় আডবাণী পথের পাঁচালীর গল্পটা শুনিয়েছিলেন। বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে রাম নয়, আমরা রামকৃষ্ণ করব। বঙ্কিম-বিবেকানন্দ-সুভাষ করব। শেষ পর্যন্ত বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী হলেও বিজেপির বাংলা প্রকল্প সফল হয়নি। বিজেপির শ্রীবৃদ্ধি না হলেও বাজপেয়ী আডবাণী কিন্তু কখনও হিন্দু-মুসলমান প্রত্যক্ষ বিভাজনের রাজনীতিও করেননি। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি সাম্প্রদায়িকতার অনুঘটক হয়ে ওঠেনি। মোদী-অমিত শাহ মুখে আধুনিক ভারত গঠনের স্লোগান দিলেও বাস্তবে সেটাই করছেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় যদি আজ বেঁচে থাকতেন, তবে অমিত শাহর কাণ্ডকারখানা দেখে তিনি সম্ভবত চমকে উঠতেন।

সেই ট্র্যাডিশন আজও আছে তো? না কি বাঙালি বিপথগামী?

এমন একটা শঙ্কা ছিল মনে। কিন্তু যখন দেখলাম, নদিয়ার কৃষ্ণনগর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে চাপড়া নামে এক মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামে একটা দুর্গাপুজো বন্ধ হতে বসেছিল। হিন্দু জনসংখ্যার অভাবে সেখানে মুসলমান যুবকেরা যোগ দিয়ে পুজোটিকে বাঁচিয়ে তোলে। পূজারি হিন্দু, আয়োজন মুসলিম গ্রামবাসীর। দেখলাম, পানিহাটিতে মহরমের তাজিয়াতে হিন্দু যুবকেরা যোগ দিয়েছে। আবার একই পাড়ায় মুসলমান যুবকেরা বিসর্জনের মিছিলে অংশ নিয়েছেন। একই দৃশ্য মুর্শিদাবাদের কিছু গ্রামেও। এই দৃশ্যগুলি দেখে মনের জোর আরও বেড়ে গিয়েছে। সাংবাদিক সাবা নকভি-র সাম্প্রতিক বইতে পড়ছিলাম কলকাতার এক ভট্টাচার্য মশাইয়ের কথা। কালীঘাটের প্রবীণ পুরোহিত তিনি। কিন্তু প্রতিদিন সকালে কালীপুজোর পর কলকাতার একটি দরগায় চাদর চড়াতে যান। গত কয়েক দশক ধরে নিয়মিত তিনি এই দুটি কাজ একসঙ্গেই করে চলেছেন। বাংলার জেলায় জেলায় সত্যনারায়ণ পুজোর সিন্নিতেও হিন্দু-মুসলমান ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটেছে, আজও এই জেলাগুলিতে গেলে সেটা বোঝা যায়।

দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে আমাদের দেশ ভাগ হয়েছে, ঠিকই। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই স্বাধীন বাংলাদেশের উদ্ভব প্রমাণ করল, ধর্ম জাতিসত্তার নিয়ামক নয়। আজ মোদী-অমিত শাহ আবার উগ্র মৌলবাদের উপাদানকে খুঁচিয়ে নবকলেবরে বাংলায় সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ রোপণ করতে চাইছেন। একটা বিজয়া দশমী-মহরমে যৌথ সাধনার ঐতিহ্যের জয় হয়েছে। কিন্তু সাধু সাবধান। বিভেদ রচনার প্রচেষ্টা নব নব কৌশলে ফিরে আসছে, আসবে। বুঝতে হবে, বাংলার মঙ্গল তথা ভারতের মঙ্গল কোন পথে? আগ্রাসী হিন্দুত্বের অভিযানে? না কি হিন্দু-মুসলমান ঐক্যবদ্ধ সাধনায়?

এখন আমরা বাঙালিরা বোধহয় গর্ব করে, কিঞ্চিৎ ছাতি ফুলিয়েও, বলতে পারি, প্রধানমন্ত্রীজি-অধ্যক্ষজি, বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন