নয়ডার বহুতল আবাসনে কী হইয়াছে, তাহা তদন্তসাপেক্ষ। কিন্তু, গৃহপরিচারিকা-নিগ্রহের সংবাদ এত বেশি চোখে প়ড়ে যে বোঝা যায়, গভীর কোনও সমস্যা আছে। পরিচারিকাকে খাইতে না দেওয়া, নিকৃষ্ট কোনও জায়গায় থাকিতে বাধ্য করা, বাড়ির বাহিরে যাইতে না দেওয়া ইত্যাদি এখন নিতান্তই সাদামাটা হইয়াছে। শারীরিক নিগ্রহের ঘটনা ক্রমবর্ধমান। এমন ঘটনাগুলির পিছনে পরিচারিকাকে ‘সম-মানুষ’ হিসাবে দেখিতে না শিখিবার অশিক্ষা বহুলাংশে দায়ী। কিন্তু, তাহাই একমাত্র কারণ নহে। যে পরিবারে নিগ্রহ করা হয় না, অথচ পরিচারিকার জন্য বরাদ্দ থাকে মাছের ক্ষুদ্রতম খণ্ডটি, বা রেস্তোরাঁয় খাইতে গিয়া পরিচারিকাকে বাহিরে বসাইয়া রাখিয়াই যাঁহারা নৈশভোজ সারিয়া ফেলেন, তাঁহাদের মধ্যেও এই অশিক্ষাটি বর্তমান। কিন্তু, তাহা শারীরিক হিংস্রতায় পৌঁছায় না। কেন নিগ্রহ হয়, সেই কারণগুলিকে বোঝা দরকার।
নিগ্রহের সংবাদগুলিকে পর পর সাজাইয়া ফেলিলে একটি নির্দিষ্ট ছক দেখিতে পাওয়া সম্ভব। প্রথমত, যে পরিবারগুলিতে এই নিগ্রহের ঘটনা ঘটিয়া থাকে, সেগুলি সচরাচর বিচ্ছিন্ন পরিবার— পাড়াপড়শির সহিত সম্পর্কহীন, আত্মীয়-বন্ধুদের সহিত যোগাযোগহীন। অর্থাৎ, এমন পরিবার, যেখানে নিগ্রহের ঘটনা ঘটিলেও সেই সংবাদ সহজে চার দেওয়ালের গণ্ডি টপকাইতে পারে না। দ্বিতীয়ত, যে পরিচারিকারা নিগ্রহের শিকার হইতেছেন, তাঁহাদের অধিকাংশই বহিরাগত। যেহেতু তাঁহাদের পক্ষে স্থানীয় কাহারও সহিত যোগাযোগ করা কঠিন, ফলে নিগ্রহকারীরা জানে, পরিচারিকার পার্শ্বে দাঁড়াইবার মতো লোক নাই। তৃতীয় একটি কারণও বর্তমান। বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নিগৃহীত মেয়েটি ভারতের আইনসিদ্ধ নাগরিক নহেন— কাজের খোঁজে হয়তো প্রতিবেশী দেশ হইতে চোরাপথে এই দেশে পৌঁছাইয়াছেন। তাঁহাদের নিকট মুখ বুজিয়া মার খাওয়া ছাড়া আর পথ কোথায়? থানাপুলিশ করিবার মতো সাহস তাঁহারা পাইবেন কী ভাবে? ফলে, গার্হস্থ্য হিংসা চলিতেই থাকে।
এই হিংস্রতা থামাইতে গেলে, অতএব, এই ফাঁকগুলি ভরাট করা বাঞ্ছনীয়। কী ভাবে, সেই উত্তর ঊনবিংশ শতক হইতে জানা আছে— শ্রমিক সংগঠনের মাধ্যমে। প্রত্যেক এলাকায় গৃহপরিচারিকাদের নিজস্ব সংগঠন প্রয়োজন, যাহাদের কাজ হইবে নিয়মিত সদস্যদের খোঁজ নেওয়া, প্রয়োজনে আইনি সহায়তা দেওয়া। বর্তমান মোবাইল ফোনের যুগে পরিচারিকারা নিজস্ব হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমেও সংযুক্ত থাকিতে পারেন। যে কোনও বিপদআপদে সেই গ্রুপের মাধ্যমেই সাহায্য চাওয়া যাইবে। প্রশাসনেরও দায়িত্ব আছে। গৃহসহায়িকা নিয়োগ করিলে এখন তাহা পুলিশকে জানাইয়া রাখিতে হয়। পুলিশ বিপরীত দিকটিরও দেখভাল করুক— কোনও নিয়োগকর্তা যাহাতে নিজের সীমা অতিক্রম করিতে সাহস না পান, পুলিশি নজরদারি তাহা নিশ্চিত করিতে পারে। মোট কথা, পরিচারিকারা যে একা নহেন, তাঁহাদের পিছনে একটি সংগঠিত শক্তি এবং প্রশাসনিক মেরুদণ্ড রহিয়াছে, নিয়োগকর্তারা যেন এই কথাটি জানেন। যাঁহারা গৃহসহায়িকার গায়ে হাত তুলিয়া বীরত্ব ফলান, তাঁহারা আসলে ভীরু। পরিচারিকার পক্ষে থাকা শক্তির খবর পাইলে তাঁহাদের আর বেয়াদপি করিবার সাহস হইবে না।