প্রবন্ধ ৩

ভোট কী পারে, কী পারে না

সোক্রাতেস বলেছিলেন, ভোট দিয়ে নৈতিকতার বিচার হয় না। আড়াই হাজার বছরেও কথাটায় জং ধরেনি। লিখছেন অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় ভোটের ফল প্রকাশের পর থেকে একটা কথা খুব শোনা যাচ্ছে: অন্য অনেক রাজ্যের মতোই পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকরাও এখন আর রাজনীতিকদের দুর্নীতি নিয়ে মাথা ঘামান না, ও সব নৈতিকতার গল্প পুরনো হয়ে গিয়েছে। কেবল ভোটের ফল দেখে এমন পাইকারি সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় কি না, হাজারটা চিন্তায় নাজেহাল ভোটদাতা ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভোট দিতে হবে’ বলে ভাবেন কি না, জানি না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৬ ০০:১৮
Share:

ভোটের ফল প্রকাশের পর থেকে একটা কথা খুব শোনা যাচ্ছে: অন্য অনেক রাজ্যের মতোই পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকরাও এখন আর রাজনীতিকদের দুর্নীতি নিয়ে মাথা ঘামান না, ও সব নৈতিকতার গল্প পুরনো হয়ে গিয়েছে। কেবল ভোটের ফল দেখে এমন পাইকারি সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় কি না, হাজারটা চিন্তায় নাজেহাল ভোটদাতা ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভোট দিতে হবে’ বলে ভাবেন কি না, জানি না। কিন্তু তার পরেও একটা প্রশ্ন বাকি থাকে: ভোটদাতারা যদি সত্যিই দুর্নীতি নিয়ে মাথা না ঘামান, তবে কি নৈতিকতা সম্পর্কে চিন্তা করারই আর প্রয়োজন থাকে না?

Advertisement

কথাটা আগেই উঠেছে। তথাকথিত স্টিং ভিডিয়ো প্রকাশের পরে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা বলেছিলেন, ‘১৯ মে এর উত্তর জেনে নেবেন।’ এই জবাবের মর্মার্থ সহজ: টাকা নেওয়ার দায়ে অভিযুক্ত নেতারা যদি ভোটে জয়ী হন এবং তাঁদের দলই যদি ক্ষমতায় ফেরে, তা হলেই প্রমাণিত হবে, জনগণের রায়ে তাঁরা সমস্ত অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়েছেন, সুতরাং তাঁরা দুর্নীতির দায় ঝেড়ে ফেলতে পারবেন। ১৯ মে জনগণের রায় তাঁদের পক্ষে গিয়েছে, ষোলো আনার বেশি আঠারো আনা গিয়েছে, অতএব ভোট খতম, পয়সা হজম।

এই বক্তব্যকে নিছক দুরাত্মার ছল বলে উড়িয়ে দিলে ভুল হবে। এর মধ্যে একটা আত্মপ্রবঞ্চনা থাকতেই পারে: ‘ভোটের স্রোতে সব পাপ ধুয়ে গেছে, জনতার আদালতে আমি এবং আমরা নির্দোষ প্রমাণিত।’ নির্বাচনী গণতন্ত্র এক বিপজ্জনক বিভ্রম তৈরি করে। এই বিভ্রম যে, জনসমর্থন সমস্ত নৈতিকতার ঊর্ধ্বে। বিশেষত যখন বিভিন্ন বর্গের বহু মানুষকে নানা ভাবে অনেক কিছু পাইয়ে দেওয়ার ভিত্তিতে শাসকের জনপ্রিয়তা গড়ে ওঠে। পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি নিয়ে তর্ক থাক। এখানে এটুকুই বলার যে, পশ্চিমবঙ্গে ইদানীং একটা কথা খুব চালু হয়েছে: রাজনীতির লোকেরা ক্ষমতায় এলে টাকা করবে, জানা কথা, কিন্তু অনেক লোকের জন্যে অনেক কিছু করা হয়েছে, সেটা তো অস্বীকার করলে চলে না।

Advertisement

এ যুক্তি ভোটের রাজনীতিতে চলতে পারে, নৈতিকতা অন্য বস্তু। রাজনীতি আর নৈতিকতার সম্পর্ক নিয়ে তর্কবিতর্ক বহু কাল ধরে চলে আসছে। আড়াই হাজার বছর আগে আথেন্সে দার্শনিক সোক্রাতেস সে তর্কে যোগ দিয়েছিলেন। তখন অবশ্য স্টিং ভিডিয়োর সুবিধে ছিল না, দরকারও হয়নি। তর্কটা ছিল, ঘুষ নয়, অন্য প্রসঙ্গে— আচরণের নৈতিকতা নিয়ে। সোক্রাতেস বলেছিলেন, অন্যায়ের শিকার হওয়ার চেয়ে অন্যের প্রতি অন্যায় করা আরও খারাপ। শুনে এক নাগরিক বলেন, বিদ্বৎসভায় এমন কথা বললে কেউ মানবে না, সবাই হাসবে। সোক্রাতেসের জবাব ছিল: ভোট দিয়ে নৈতিকতার বিচার হয় না।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছের এবং কাছে-আসতে-চাওয়া মানুষরা এখন তাঁর জয়ধ্বনি দেবেন, তাঁর উচ্চারিত প্রতিটি শব্দে এবং দাঁড়ি কমা সেমিকোলনে হাততালি দেবেন, সত্য কথা বলবেন না। ক্ষমতাকে সত্যকথা শোনানোর অভ্যেস তাঁর রাজত্বে সুলভ নয়। তাই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নতুন করে শপথ নেওয়ার সময় তিনি অনেক দিন আগের সেই সত্যবদ্ধ দার্শনিকের দামি কথাটা মনে রাখতে পারেন, উপকার পাবেন। তাঁর নেতৃত্ব জনসাধারণের রায়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু নেতৃত্ব মানে করতালিমুখর জনসাধারণের দ্বারা চালিত হওয়া নয়, জনসাধারণকে চালনা করা। সে চালনায় নৈতিকতার একটা অলঙ্ঘ্য স্থান আছে, ২৯৪টা আসন একা পেলেও সেটা সমান অলঙ্ঘ্য থাকে। বস্তুত, আধিপত্য বেশি হলে দায় সেই অনুপাতে বাড়ে।

জানি, নৈতিকতা কেবল ঘুষ নেওয়া-না-নেওয়ার প্রশ্নে সীমিত নয়। শাসকের কাছে তার আরও অনেক দাবি। কিন্তু আপাতত ওই স্টিং ভিডিয়োর কথাতেই ক্ষান্ত হওয়া যাক। দৃশ্যগুলো বড় লজ্জাকর, ভোলাও বেশ কঠিন।

ঋণ: হোয়ট ইজ মরালিটি, টমাস স্ক্যানলন। হার্ভার্ড (২০১১)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন