কৈফিয়ত: নীরব মোদীর পালিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের বিক্ষোভ। দিল্লি, ফেব্রুয়ারি ২০১৮। এএফপি
কলকাতায় বসে যতগুলি সর্বভারতীয় কাগজের সংস্করণ পাওয়া যায় ও পড়া যায়, সেগুলির ২১ মার্চের সংস্করণে কোথাও, কোনও কাগজে এই খবরটি নেই যে, লন্ডনে নীরব মোদী কী ভাবে ধরা পড়লেন। একটি কাগজে এইটুকু উল্লেখ আছে যে নীরব মোদী এক ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলতে গিয়েছিলেন ও সেখানে লন্ডন পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। লন্ডনে পুলিশ তো একশো রকম।
আনন্দবাজার পত্রিকার লন্ডনের সংবাদদাতা শ্রাবণী বসুর স্বাক্ষরিত সংবাদেই একমাত্র আমরা জানতে পারলাম, যাকে বলে প্রত্যক্ষদর্শীর, বা ঘটনার প্রধান সংঘটকের কথা। ২০ মার্চ লন্ডনের মেট্রো ব্যাঙ্কের এক শাখায় অ্যাকাউন্ট খুলতে এসেছিলেন নীরব মোদী। তাঁকে চিনে ফেলেন ব্যাঙ্কের এক কর্মী। শ্রাবণী বসু কোনও নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি করেননি। ঘটনাটির বিবরণ দিয়েছেন এই সারল্যে: ‘‘চেনা অসম্ভব ছিল না। ইদানীং এই ‘গ্রাহক’কে নিয়ে টিভি-ইন্টারনেট সরগরম। কর্মীটি দ্রুত ডায়াল করেছিলেন একটা নম্বর। একটু পরেই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড-এর অফিসাররা ঘিরে ফেলেছিলেন অ্যাকাউন্ট খুলতে আসা নীরব দীপক মোদীকে।’’
যে হেতু ঘটনার এই অনাটকীয়তার অন্য কোনও সাক্ষী নেই, তাই, সেই ফাঁকটাকে নানা জল্পনা দিয়ে ভরিয়েছে প্রায় সব কাগজ।
জল্পনা ১: ভারতের আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ বললেন, ‘‘চৌকিদার সে বচনা মুশকিল হি নহি, নামুমকিন হ্যায়।’’ ওই সাইজ়ের আর এক নেতা বলেছেন, ‘‘যারা দেশ থেকে পালিয়েছে, তাদের সবাইকে নাকে দড়ি দিয়ে চৌকিদার দেশে ফেরাবে।’’
জল্পনা ২: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘গট আপ গেম, নরেন্দ্র মোদী পালাতে বলেছিলেন, তিনিই ধরা দিতে বলেছেন ভোটের সুবিধের জন্য।’’
জল্পনা ৩: এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট কাউকে (কাকে, সেটা বলা হয়নি) নীরব মোদীকে ফেরত পাঠাতে বলে ও এক লন্ডন কোর্ট নীরব মোদীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। তার কয়েক দিনের মধ্যেই এই গ্রেফতার।
ঘটনা ১: ২০১৮’র ১ জানুয়ারি থেকে ৬ জানুয়ারির মধ্যে দেশ ছাড়েন পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক (পিএনবি) লুটের শরিকরা। নিশান, নীরব, মামা চোক্সী ও নীরবের স্ত্রী— আলাদা-আলাদা। তত দিনে পিএনবি লুটের প্রাথমিক খবর ওই ব্যাঙ্কের ও রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের তদন্ত শাখার নজরে এসেছে।
কিন্তু ‘সন্দেহবশে’ও তাঁদের বিদেশযাত্রা আটকানো হয় না।
ঘটনা ২: বরং ১৮ জানুয়ারি দাভোস-এ ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম-এর সভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দলের অন্তর্গত হয়ে নীরব মোদী নিজেকে ‘সন্দেহের বাইরে’ নিয়ে যান, যদিও ইতিমধ্যে ১৫ দিন কেটে গিয়েছে ও ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ, অর্থমন্ত্রী, বিদেশমন্ত্রী ব্যাপারটি জেনে গিয়েছেন।
ঘটনা ৩: ২৯ থেকে ৩১ জানুয়ারির মধ্যে নীরবের বিরুদ্ধে সিবিআই ও ইডির লুক-আউট নোটিস জারি হয়। সরকারের প্রথম ‘হস্তক্ষেপ’।
ঘটনা ৪: ২ জুলাই রেড কর্নার নোটিস জারি। দুনিয়া জুড়ে তাঁকে ফেরারি আসামি বলে ঘোষণা।
এখানেই থামছি শুধু এইটুকু প্রমাণের জন্য যে, ২০১৮’র ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৯-এর ১৯ মার্চ পর্যন্ত ১৫ মাস সময়ের মধ্যে ভারত ব্রিটেনের সঙ্গে সরকারে-সরকারে কোনও কথা বলেনি, কোনও চিঠি চালাচালি করেনি, এই উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে কথা বলতে দিল্লি থেকে কেউ যাননি। লন্ডনে তো ভারতের বেশ বড়সড় হাই কমিশন আছে। সেখানে নানা বিশেষজ্ঞও আছেন। তাঁরাও এ বিষয়ে কোনও উদ্যোগ করেননি, যে হেতু বিদেশ মন্ত্রক তাঁদের জানায়নি। রেড কর্নার নোটিসের গুরুত্ব আমাদের কাছে যা, ব্রিটেনে তার বিপরীত। তার ঐতিহাসিক কারণ আছে।
আমাদেরও প্রতিটি থানায় ‘রেড কর্নার নোটিস’ বোর্ড আছে। অ-শনাক্ত মৃতদেহের, ফেরার আসামির ছবি তাতে সাঁটা থাকে। ভুল করেও কেউ সে বোর্ডের সামনে দাঁড়ায় না।
নীরব মোদীর বিরুদ্ধে রেড কর্নার নোটিস জারি হয়েছে আর্থিক অপরাধের জন্য। আর্থিক অপরাধে ফেরারি খুব জটিল জীব।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ইংল্যান্ডকে সম্পূর্ণ একা যুদ্ধ করতে হয়েছিল প্রায় দু’বছর। ব্রিটিশ নাগরিকদের নাগরিক-চেতনা সেই যুদ্ধের প্রতিরোধ থেকে গুণগত বদলে যায়। যেমন, লাল ফৌজের সামরিক চেতনা যুদ্ধের চরিত্রটাকেই বদলে দেয়। প্রতি দিন রাতে জার্মানির বোমা। ব্রিটেনের শেষ যুদ্ধজাহাজটি ডুবিয়ে দেওয়ার পর প্রতি রাতে ভয়— জার্মানি ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে সমুদ্রপথে আক্রমণ করবে কি না। প্রধানমন্ত্রী অনেক রাতে নিজের শোয়ার ঘরের দরজায় স্লিপ টাঙিয়ে দিতেন: ‘‘এক যদি জলপথে আক্রমণ হয় তা হলেই আমায় ডেকো।’’ তার পর লন্ডন থিকথিক করত ইউরোপের নানা দেশের উদ্বাস্তুতে। তাদের মধ্যে অনেকে গুপ্তচরও থাকত। ফলে ইংরেজরা কোনও সরকারি নোটিসকে অগ্রাহ্য করত না। বিশেষ করে লুক-আউট নোটিস। তখন তো আর মোবাইল ফোন ছিল না। মানুষজন দাঁড়িয়ে লুক-আউট নোটিসের লোকটির চেহারা মনে রাখত। আর তখন থেকেই ইংল্যান্ডের সংবাদপত্রের জগতে একদল সাংবাদিক দেশরক্ষার দায়িত্বে লুক-আউটদের সন্ধানকে তাঁদের পেশার অন্তর্গত করে নেন। সেই দায়িত্ববোধ ইংল্যান্ডের, বিশেষত, লন্ডনের নাগরিক-চেতনার অংশ হয়ে গিয়েছে। সেটা অবহেলা করা নিজের কাছে অপরাধ। তাই মেট্রো ব্যাঙ্কের সেই কর্মীটি নীরব মোদীকে চিনে ফেলামাত্র স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড-এ ফোন করে দেয়। দুই কান করে না।
এই লেখাটি লিখতে প্ররোচিত হই এই কারণে যে, লন্ডন ও ইংল্যান্ডের নাগরিকরা নিজেদের নাগরিক গুণে ও প্রশাসনিক গুণে যে কাজটি করলেন, তার মুনাফা আমাদের দেশে লুটতে চাইছেন ভারতীয় জনতা পার্টি ও নরেন্দ্র মোদী। কাগজগুলোতেও এটা একটা গল্প হয়ে উঠেছে। নীরব মোদী এক লাখ টাকা দামের উটপাখির চামড়ার জ্যাকেট পরে লন্ডনের রাস্তায় ঘুরছেন— এটা কোনও অনিবার্য খবর নয়।
কিন্তু ভারত সরকার, নীরব মোদী পালানোর পর, একটা কোনও, কোনও একটা সরকারি ব্যবস্থা করেছে? তার হাই কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে? কোনও মন্ত্রী গিয়েছেন ওখানকার কোনও মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে? সবচেয়ে বড় কথা, সিবিআই ও ইডি এই প্রায় চোদ্দো হাজার কোটি টাকার লুটকে শুধু অর্থনৈতিক অপরাধ বলে চিহ্নিত করল কোন যুক্তিতে? অর্থনৈতিক অপরাধ ঘটার পদ্ধতি কি ফৌজদারি আইনের পদ্ধতির সঙ্গে মিলে যেতে পারে না? এটিএম-এর দরজা ভেঙে আমাদের দেশে যারা ধরা পড়ে, তাদের কি অর্থনৈতিক অপরাধী বলা হয়, না কি ফৌজদারি অপরাধী বলা হয়? আমি যদি অন্যের সই নকল করে টাকা তুলি, সেটা কি অর্থনৈতিক অপরাধ না কি ফৌজদারি অপরাধ?
ঝড়ে বক মরেনি। ফকিরের কেরামতিও প্রমাণ হয়নি। কিন্তু দু’টি সরল প্রশ্নের সরল উত্তর চাই। এক, নীরব মোদী সম্পর্কে কোনও সরকারি উদ্যমের প্রমাণ কী? দুই, নীরব মোদীকে সরকার কোন ধারার অপরাধী মনে করে?