সাত বৎসর পর আবার শ্রীলঙ্কায় জরুরি অবস্থা ঘোষিত। ভয়ানক জাতিদাঙ্গায় নিমজ্জিত দেশে আপাতত সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করিয়া হিংসার তাণ্ডব কমাইবার চেষ্টা চলিতেছে। যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি, রক্তপাত, প্রাণঘাত ঘটিয়াছে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে, তাহা বুঝাইয়া দেয়, ইহা কোনও আকস্মিক সংকট নহে, বরং অনেক দিনের ধিকিধিকি স্ফুলিঙ্গ হঠাৎ দাউদাউ অগ্নিকাণ্ডের রূপ পাইয়াছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ও সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে অশান্তি ও ক্ষোভের আদানপ্রদান অনেক দিন ধরিয়াই। ক্যান্ডি নগরে একটি গণপিটুনি-নিধনের সূত্রে সেই আদানপ্রদান এখন ক্যান্ডি ছাড়াইয়া দেশের অন্যত্রও ত্রাস ও সন্ত্রাস ছড়াইতে শুরু করিয়াছে। সচরাচর যাহা হয়, এমন ক্ষেত্রে গুজব একটি বিশেষ সক্রিয় ভূমিকা পালন করিতেছে, এবং ঝড়ের বেগে গুজব রটাইতে সাহায্য করে সোশ্যাল মিডিয়া। ফেসবুক বন্ধ না করিয়া শ্রীলঙ্কা প্রশাসনের তাই উপায় নাই। প্রশাসন যদি দ্রুত ও দক্ষ ভাবে অবস্থা আয়ত্তে না আনিতে পারে, তাহা হইলে পরিস্থিতি অতি শোচনীয় হইবার সম্ভাবনা, কেননা যে অঞ্চলটি সংকটের কেন্দ্র, সেখানে বৌদ্ধরা জনসংখ্যার প্রায় পঁচাত্তর শতাংশ।
অভিযোগ অবশ্য সেই প্রশাসনকে লইয়া, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা লইয়া। প্রাথমিক ঘটনার পর যদি পুলিশ যথাসময়ে পদক্ষেপ করিত, সংকট তবে এত দূর গড়াইত না, এত মানুষ মরিত না, এত বাড়িঘর, দোকানপাট জ্বলিত না— বহু প্রত্যক্ষদর্শীর অভিমত। বৌদ্ধ দুষ্কৃতীদের প্রতি প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বের এই অভিযোগ আংশিক ভাবেও সত্য হইলে বলিতে হয় বহু বৎসরের রক্তক্ষয়ী এলটিটিই-সিংহলি দাঙ্গা শ্রীলঙ্কাকে কোনও শিক্ষা দিতে পারে নাই। জাতিদাঙ্গার পথটি যে কত ভয়ানক দীর্ঘ ও রক্তাক্ত হইতে পারে, তাহা সে দেশ ভুলিয়া গিয়াছে। বাস্তবিক, এলটিটিই পর্বের শেষ ভাগ হইতেই শ্রীলঙ্কার রাজনীতির পরবর্তী সংকটের শুরু। তামিল নিকেশ প্রকল্পে যে-ভাবে গোটা দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সরকারি তথা দলীয় কর্তৃত্ব স্থাপিত করিয়া গিয়াছিলেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মহেন্দ্র রাজাপক্ষে, বিপুল আন্তর্জাতিক নজরদারি উপেক্ষা করিয়া সরকারি গণহত্যাকে দেশের ‘অভ্যন্তরীণ ঘটনা’ বলিয়া চালাইয়াছিলেন, তাহা সে দেশের বহুসংস্কৃতি-অধ্যুষিত সমাজের বারোটা বাজাইয়া দেয়। বুঝাইয়া দেয়, চিন্তার কারণ নাই, সরকারি সমর্থনে যে কোনও নৃশংসতা দিব্য চলিতে পারে।
পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাজাপক্ষের পরাজয় সাময়িক ভাবে বৌদ্ধ সিংহলি উগ্রতাকে কমাইতে পারিয়াছিল ঠিকই। কিন্তু ২০১৬ সাল হইতে আবারও বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষে প্রমাণ, সাময়িক লয়ের পর ধর্মীয় রাজনীতির উগ্রতার প্রবল প্রত্যাবর্তন আসন্ন। প্রসঙ্গত, সংখ্যাগুরুর ক্ষোভটিও ফেলনা নয়। মুসলিম সংখ্যালঘু অঞ্চলগুলিতে কয়েক বৎসরের মধ্যে হিংসার দৌরাত্ম্য বাড়িয়াছে, সংখ্যাতত্ত্বই তাহা বলিয়া দিবে। বৌদ্ধ নেতাদের অভিযোগ, আরব দেশ হইতে জঙ্গি ইসলামের আমদানি হইতেছে। অভিযোগটির পিছনে কোনও সত্যতা নাই, এমন বলা মুশকিল। সব মিলাইয়া শ্রীলঙ্কা আবারও প্রবল সামাজিক সংকটের আবর্তে ঢুকিয়া পড়িল। আবার এক নূতন ধারার জাতিদাঙ্গায় গ্রস্ত হওয়ায় দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ-ক্লান্ত দেশটির সাময়িক স্থিতি ও আপাত-শান্তির পর্বে বড় রকমের ছেদ পড়িল।