প্রেমবিরোধী সেনা আমরাও

ভ্যালেন্টাইন’স ডে পালন করা কতটা প্রতিবাদী, আর তার বিরোধিতা কতটা প্রতিক্রিয়াশীল, এমন একটা ভাব ফুটে ওঠে।

Advertisement

ঈশা দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৬:১০
Share:

চোদ্দোই ফেব্রুয়ারি দিনটা কেন্দ্র করে খুব ঝামেলা হয়, গত কয়েক বছর ধরেই জানা। ওটি সেন্ট ভ্যালেন্টাইন-এর মৃত্যুদিন, যিনি মধ্যযুগের এক রোমান সন্ত, সেটা আমাদের মনে না থাকলেও, ভ্যালেন্টাইন’স ডে উপলক্ষে শিব দুর্গা ইত্যাদি সেনারা যে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন তা বেশ মনে থাকে। আমাদের রাজ্য এই সব ব্যাপারে একটু পিছিয়ে ছিল— বোধহয় আর বেশি দিন থাকবে না! গত বছরই এই দিনে বজরং দল ও শিবসেনা বেঙ্গালুরু, মুম্বই, ভুবনেশ্বর, কানপুর ইত্যাদি শহরে বিভিন্ন জায়গায় ভাঙচুর করে। প্রেমিক-প্রেমিকাদের উত্ত্যক্ত করা, মারধর, এমনকী জোর করে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা পর্যন্ত হয়।

Advertisement

এই সব ঘটনায় বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদ করেন, নতুন করে কোনও কিছু ঘটলে প্রতিবাদ ইত্যাদিও নতুনত্ব পায়। কেন নীতিপুলিশি ভাল নয়, এই নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে তার শাখাপ্রশাখা গরু, সিনেমা ইত্যাদি নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ভ্যালেন্টাইন’স ডে পালন করা কতটা প্রতিবাদী, আর তার বিরোধিতা কতটা প্রতিক্রিয়াশীল, এমন একটা ভাব ফুটে ওঠে।

কারা এই ভ্যালেন্টাইন’স ডে-র বিরোধী? অবশ্যই যাদের কথা এক্ষুনি বলা হল, বিভিন্ন সেনা ইত্যাদি। কিন্তু যাদের কথা চট করে মনে পড়ে না, বা মনে পড়লেও যাদের কথা আমরা বলি না, তারা হলাম আমরা নিজেরা। আমরা, যাদের মধ্যেও কমবেশি শিব-দুর্গা-করণী সেনা লুকিয়ে আছে। যাদের মোটেই পছন্দ নয় প্রেমের দিন উদ্‌যাপন। দাপাদাপি করে বিরোধিতা করতে পারি না ঠিকই, কিন্তু অন্য কেউ দাপাদাপি করে বন্ধ করে দিতে পারলে আনন্দিতই হব।

Advertisement

সেনাদলের বিরোধিতার কারণ তো তাদের দলীয় কর্মসূচি, ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব। কিন্তু আমরা, যারা সাধারণ লোক? তাদের বিরোধিতার কারণ কিন্তু অনেক সময়ই পারিবারিক। আমার ছেলে বা মেয়ে, বোন বা ভাই ভ্যালেন্টাইন’স ডে উদ্‌যাপনের চেষ্টা করছে, এটা জানা মাত্র আমাদের মধ্যে একাধারে ছবি বিশ্বাস, কমল মিত্র, সন্ধ্যারানি, নিরুপা রায়েরা জেগে ওঠেন। আমরা বকে ধমকে কেঁদে ককিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করি, এই সব ভ্যালেন্টাইন’স ডে-টে কতটা অপ্রয়োজনীয়, এখন তার পড়াশোনা করার সময়, এই সব হুজুগে সময় নষ্ট করার কথা সে যেন কখনওই না ভাবে। বাবা-মা হিসাবে আমাদের মনে নানা রকম ভয় কাজ করে। সবচেয়ে প্রথমে ছেলে বা মেয়ের নিরাপত্তার ভয়ের কথা মনে আসার কথা, সেই চিন্তা আসে সব থেকে পরে। প্রথমে যা আসে, তা অবশ্যই সন্তানের উপর কর্তৃত্ব হারানোর ভয়। এই ভয়ের কথা আমরা স্বীকার করি না, অথচ এই ভয় চিরকালীন। শর্তনিরপেক্ষ ভালবাসা এমনিতেই হয় না, আর বাবা-মা’র তো সন্তানের থেকে আশা-প্রত্যাশার শেষ থাকে না। সেই প্রত্যাশার সমীকরণে তৃতীয় পক্ষের আবির্ভাব এবং ভ্যালেন্টাইন’স ডে উপলক্ষে সেই আবির্ভাবের দামামা, বাবা-মা’র পক্ষে অসহনীয় হয়ে ওঠে। ‘ওরে, তুই ভ্যালেন্টাইন’স ডে-র দিন সেজেগুজে বেরোস না’— বলার সাহস জোগাড় করা মুশকিল। তুলনায় ‘আজ পথেঘাটে অমুক সেনারা হাঙ্গামা করবে বলেছে, আজ আর যাস না’— এ রকম বলে ফেলা সোজা। এ-ক্ষেত্রে আমাদের (বাবা-মা’দের) সঙ্গে সেনাদের তেমন তফাতও রইল না, কিন্তু উলটে তাদের ঢাল হিসাবে ব্যবহার করাও গেল।

এই ভাবে যদি আটকাতে না পারি, তা হলে চিন্তা হয়, যার সঙ্গে আমার সন্তান আজ বেরোচ্ছে, সেই ছেলেটি বা মেয়েটি কে? আর এখন, সেই চিন্তায় আরও এক মাত্রা যোগ করেছে এলজিবিটি অধিকার আন্দোলন। ছেলে বা মেয়ের মুখে কথাটা শুনেছেন, আপনি যথেষ্ট মুখ কোঁচকানো সত্ত্বেও তারা এর পক্ষ নিয়ে কথা বলে যাচ্ছে। কাগজে, পত্রিকাতেও মাঝে মাঝে এ-সব অসৈরন কথাবার্তা, ছবি আপনার চক্ষুশূল হচ্ছে। মোদ্দা কথা, আপনি বুঝতে পারছেন আপনি চান বা না-চান, এলজিবিটি বাস্তব। তাই, আগে মেয়ের ছেলেবন্ধু এলে কোল্ডড্রিংকস দেওয়ার নাম করে নজরদারি করতেন, এখন মেয়েবন্ধু এলেও আপনি স্বস্তিতে থাকেন না।

ভ্যালেন্টাইন’স ডে এলে আপনার চিন্তা চতুর্গুণ হয়ে ওঠে। আপনার মেয়েটি সেজেগুজে ছেলের সঙ্গে গেলেও চিন্তা, মেয়ের সঙ্গে গেলেও চিন্তা। তার থেকে এই সব সেনাটেনারা ভাঙচুর করে সব বন্ধ করে দিলেই ভাল হয়। কোমরে আঁচল গুঁজে রান্নাঘর পরিষ্কার করতে করতে আপনি অভিসম্পাত করেন ছেলে বা মেয়ের বন্ধুদের, বা অজানা বিশেষ বন্ধুকে, ভ্যালেন্টাইন’স ডে-র উদ্‌যাপনকে, আর কখন আপনি নিজেই সেনাদলের অংশ হয়ে যান।

বাবা-মায়ের উদ্বেগ না-হয় এক শতাংশ সমর্থন পেল। কিন্তু আমাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ঈর্ষা, যাকে ‘যৌন ঈর্ষা’ বলে দেগে দিলে আমরা অপমানিত বোধ করব? বাবা-মা’র যৌন ঈর্ষা হচ্ছে না এমনটা না-হয় ধরে নেওয়া গেল, কিন্তু বাবা-মা ছাড়াও আমাদের অস্তিত্ব আছে। আমরা অমুক বাবু, অমুক কাকু, তমুক মাসিমা, অমুক দাদা, তমুক দিদি। আমরা সেই অমুক অমুক যারা ‘হোক কলরব’-এ উত্তেজিত হই, ‘হোক চুম্বন’-এ আরও উত্তেজিত হই কিন্তু ‘গেল গেল’ রব তুলি। ‘হোক কলরব’ বা ‘হোক চুম্বন’ প্রতিবাদের ঠিক পদ্ধতি, এমন কোনও প্রমাণ নেই। কিন্তু কিছু কমবয়সি ছেলেমেয়ে যদি অবাস্তব পদ্ধতিতে প্রতিবাদের চেষ্টাও করে, আমাদের অসুবিধেটা কোথায়? আমরা তো এমনিতেই নড়াচড়া বন্ধ করেছি, রাতবিরেতে কাশি এবং দিনবদল ইত্যাদি শব্দ কোনও দিন বলতাম-শুনতাম বলে মনেও পড়ে না। এখনকার যৌবন এখনকার মতো করে বাঁচছে। সে প্রতিবাদই হোক, প্রেমই হোক, এলজিবিটি অধিকারই হোক। আমাদের কাছ থেকে আলাদা করে সমর্থন, চাঁদা, কিছুই চাইছে না। তা হলে আটকাচ্ছে কোথায়? আমাদের আর সেই জীবনবেলাটা নেই— চাইলেও আমাদের কেউ খেলার সময় দলে নেবে না, সে জন্যেই কি এত রাগ? তাই তাদের দলেই মনে মনে অংশ হচ্ছি, যারা প্রেম প্রতিবাদ কিছুতেই বিশ্বাস করে না, ভাঙচুর ধ্বংসই যাদের কাছে সত্যি?

এই ভ্যালেন্টাইন’স ডে-তেও আমরা কি বানর সেনার দলে নাম লেখাব? মনে মনে? না কি চেষ্টা করব প্রেম দিবসকে ‌খুশিমনে মেনে নেওয়ার?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন